কথা বললেই মামলা

news paper

সাজেদা হক

প্রকাশিত: ১৫-৩-২০২৩ দুপুর ৩:২১

73Views

দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে নোমান গ্রুপ। এই সপক্ষে অবশ্য তারাই প্রমাণও রেখে দিয়েছেন অত্যন্ত সচেতনভাবেই। অথচ তাদের নানাবিধ অনিয়মের কথা বললেই শায়েস্তা এবং হয়রানি করতে জুড়ে দেন মামলা। মামলাই তাদের হাতিয়ার বলা চলে স্ট্যান্ডবাজি। মামলাবাজ নোমান গ্রুপের প্রধান কর্ণধার নূরুল ইসলাম। তার নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে মামলায় বাদী হিসেবে নাম লেখান নোমান গ্রুপে কর্মরত কর্মীরা। বিনিময়ে আদায় করেন, অর্থ, পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুবিধা। নোমান গ্রুপের অন্যায় আচরণের, বৈষম্যের এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শায়েস্তা করতে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক মামলার বাদী হয়েছে নোমান গ্রুপ এবং নোমান গ্রুপের প্রতিনিধি।

তাদের এই মামলাবাজ আচরণের শিকার হয়েছেন বিভিন্ন সাংবাদিক, সাবেক কর্মী এবং বিভিন্ন অসহায় ব্যক্তি।  নাম প্রকাশ না করার শর্তে নোমান গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব মামলা পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট সেল আছে নোমান গ্রুপের। সেসব সেলে হাইপেইড কর্মীরা কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করেন কোর্টের নিম্ন স্তরের কর্মী থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতনরা। কোর্টের মুহুরী এবং পেশকারদের অনেকেই নিয়মিত মাসোহারা নেন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা রেখেই এসব মামলাকে হাতিয়ারে পরিণত করেছে নোমান গ্রুপ-অভিযোগে এমনও দাবি করেছেন ওই কর্মকর্তারা। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে নোমান গ্রুপ এবং তাদের কর্মকর্তাদের সখ্যতার বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়ানো ছিটানো। এসব সুসম্পর্কের জোরেই (পুঁজি করে) হয়রানিমূলক মামলাগুলো গতি পায় বলে দাবি করেছেন নোমান গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা আরও জানান, ব্যবসায়িক কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে পারটেক্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা সাতশ’রও বেশি হবে। সূত্রের দাবি, ঋণ নিতে কমিশন চক্র আর কেউ প্রতিবাদ বা মুখ খুললে তাদের মামলা দিয়ে দমন করার নীতিতেই বিশ্বাস করেন নোমান গ্রুপের কর্ণধার মো. নূরুল ইসলাম। 

গণমাধ্যমের মুখ বন্ধে মামলা
সম্প্রতি দৈনিক সকালের সময় পত্রিকায় ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর প্রকাশিত  ‘ব্যাংক গিলছে নোমান গ্রুপ’ প্রতিবেদন প্রকাশের পর পত্রিকার প্রতিবেদক ও সম্পাদকের নামে দুই হাজার কোটি টাকার মামলা দেয় নোমান গ্রুপ। সিআর মামলা নম্বর ৩৮৫/২২। এর আগে ৩১ অক্টোবর ২০২২ সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ‘ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা’র প্রতিবেদনটির জন্য প্রতিবেদক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে  নোমান গ্রুপ। সিআর মামলা নং ৪২৭/২২। মামলা দুটি বিচারাধীন। 
ব্যক্তি আক্রোশে মামলা
এরআগে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া আধুনগরের মরহুম ছিদ্দিক আহমদের ছেলে আনোয়ার হোসাইনকে মিথ্যা মামলায় আটক করতে একাধিক মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি জামায়াতের আমির অধ্যাপক আসাদ উল্লাহ এবং স্থানীয় থানার ওসি আতিকুর রহমান ও নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম মিটিং করেন। যার ছবি প্রতিবেদনে সংযুক্ত। স্থানীয় পুলিশ সুপারের কাছে এ বিষয়ে একটি অভিযোগও দাখিল করেছেন ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসাইন।  
সাবেক কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর নোমান গ্রুপের মালিককে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন করেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়াররা। মানববন্ধনে জানানো হয়, কারখানার সিনিয়র জিএম মাসুম আজাদকে শারীরিক নির্যাতন ও জীবননাশের হুমকি দিয়েছেন নোমান গ্রুপের মালিক। পরে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার মারুফের ওপর বর্বর অত্যাচার চালায় নোমান গ্রুপ। মাসুম আজাদের নামে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে ভালুকা থানায় চুরির মামলা দায়ের করে নোমান গ্রুপ।  মাসুম আজাদকে গ্রেপ্তারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়েরও স্মরণাপন্ন হন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক নাসিম উদ্দিন সরকার।  ময়মনসিংহ ভালুকা থানায় ০৫ ও ০৬ নভেম্বর দু’টি মামলা করা হয়। মামলা নম্বর- ১০ ও ১১।
জমির মূল মালিকের বিরুদ্ধে মামলা
টঙ্গির পাগাড় এলাকায় বন্ধকী এই সম্পত্তির বিশাল অংশ জুড়ে এখন নূরুল ইসলামের ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি.’র টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ। তবে রেকর্ড এবং আদালতের ডিক্রিমূলে ওই সম্পত্তির ১৬ আনা দাবি করেছিলেন কাজী মো. মশিউর হোসেন। মালিকানা নিয়ে কাজী মশিউর হোসেন ও তার স্ত্রী শারমিন আক্তারের সঙ্গে মামলা (নং-৫২/২০০০) ছিল আবুল কাসেম চৌধুরীর। মালিকানা দাবির ওই মামলায় কাজী মশিউর এবং শারমিন আক্তার পাগাড় হাউজিংয়ের মূল মালিকের ওয়ারিশদের কাছ থেকে ১৭/০১/১৯৮৯ সালে সম্পত্তিটি কিনেছেন মর্মে উল্লেখ করা হয়। কাসেম ও মসিউর হোসেনের মধ্যকার বিরোধের বিষয়টি জানতেন নুরুল ইসলাম। এই বিরোধকে কাজে লাগান তিনি। ফ্যাক্টরী সংলগ্ন সম্পত্তি করায়ত্ত করতে নূরুল ইসলাম প্রভাবশালী আবুল কাসেম চৌধুরীর সঙ্গে হাত মেলান। বিরোধপূর্ণ জমিটি ব্যাংকে মর্টগেজ অবস্থায়ই দলিল সৃষ্টি করেন। কিছু অংশের দলিল করেন স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে। কিছু অংশ কেনেন সুফিয়ার বড় ভাই সামশুল ইসলামের নামে। সুফিয়ার আরেক ভাইয়ের ছেলে ইমরান আহমেদ চৌধুরীর নামেও কিছু অংশের দলিল সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে আদালত থেকে মালিকানার ডিক্রি লাভ করেন মশিউর হোসেন ও শারমিন আক্তার। আদালত তার আদেশে আবুল কাসেম চৌধুরীর মালিকানা বিলুপ্ত করেন। কিন্তু মামলায় হেরে আপিল (নং-৫৪/২০০৯) করেন আবুল কাসেম চৌধুরী। ওই আপিলে মো. নূরুল ইসলাম, তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, কাজী মশিউর হোসেন ও স্ত্রী শারমিন আক্তার এবং সুফিয়া খাতুনের ভাইয়ের ছেলে ইমরান আহমেদ চৌধুরীকে বিবাদী করা হয়। কাজী মশিউর হোসেন ও শারমিন আক্তার আপিলেও জেতেন। এতে ওই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক হন কাজী মশিউর-শারমিন। তাদের নামেই নামজারি হয় সম্পত্তিটির। এ রায়ে বন্ধকী সম্পত্তির ওপর আবুল কাসেম চৌধুরীর মালিকানা দাবি ভুয়া প্রমাণিত হয়। 

মামলা নং-৩৩: চট্রগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর সর্দানী পাড়ার মৃত সিদ্দিক আহমদের ছেলে হারুনের বিরুদ্ধে ৯৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় মিথ্যা মামলা দেয়া হয়  মতিঝিল থানায়,  সেই মামলা নং ৩৩। এই মামলায় একতরফাভাবে রায় করিয়ে নেয় নোমান গ্রুপ। মূলত নোমান গ্রুপের কাছ থেকে পাওনা বাবদ সাড়ে ৩ কোটি টাকা ফেরত চাইলে মামলা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। 

রিট তুলে নিতে বাদীকে চাপ
রিট (নং ১০৭১৬/২০২২ এবং ১০৭১৭/২০২২): নোমান গ্রুপের বহুবিধ জালজালিয়াতি ও অর্থনৈতিক অপরাধের তথ্য ফাঁস করে দেবে-এই ভয়ে প্রথম হারুনের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিতে থাকেন। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্প্রতি দেলোয়ার হোসাইনের ভাই আনোয়ার হোসাইন ২টি রিট (নং ১০৭১৬/২০২২ এবং ১০৭১৭/২০২২) করেন। এতে যারপর নাই ক্ষিপ্ত হয় নোমান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মালিকগণ এখন মিথ্যা মামলা দিয়ে চাপ সৃষ্টি করছেন রিট প্রত্যাহার করে নিতে। এসব মামলায় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে দিয়ে তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করানো হয়। ঘন ঘন তারিখ ফেলে এক সময় একতরফা রায় করিয়ে নেয়া হয়। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর হারুন জামিনে মুক্তি পান। এরপরও তাকে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে হত্যা চেষ্টা করা হয়। সম্প্রতি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নতুন এক মামলায় হারুনের অনুপস্থিতিতে একতরফা রায় করিয়ে নিয়েছে নোমান গ্রুপ। চট্রগ্রাম কোতোয়ালী থানার মামলা নং ৭০(০৬)১৭, চট্টগ্রাম সাঃ ট্রাঃ মামলা নং-২৯৮/২১। 
মাদ্রাসা শিক্ষকের নামে মামলা
আধুনগর ইসলামীয়া কামিল মাদ্রসায় ২০০১ সালে মাওলানা কুতুব উদ্দীন নামক এক শিক্ষককে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে অস্ত্র দিয়ে নাটক সাজিয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করান নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যন নুরুল ইসলাম।  ৪ মাস জেল হাজত বাস করে শেষে জামিনে বের হন ওই শিক্ষক। পরে আদালতে মামটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। লোহাগাড়া থানার মামলা নং ৭ (১২)২০০১, জি,আর নং-১২৮/২০০১।
আয়েশা বেগমের ঘরে আগুন
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানায়, নোমান গ্রুপের মালিক নুরুল ইসলামের নির্দেশে গাজীপুর শ্রীপুরে বিগত ১২/২/২০১২ ইং তারিখে জমি লিখে না দেওয়ায় অসহায় আয়েশা বেগম নামক এক গরিব মহিলার ঘর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে আয়েশা বেগমের দুই ছেলের বিরুদ্ধে প্রথমে নারী নির্যাতন মামলায় পরে চাঁদাবাজী মামলা দায়ের করে নোমান গ্রুপ। এ খবর ২২ মার্চ ২০১২ সালের একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। 
টঙ্গীতে কর্মীদের বিক্ষোভ দমন
১৯ জুলাই ২০১৪ সালে টঙ্গীতে ঈদের বেতন ভাতা না পেয়ে বিক্ষোভ করেন নোমান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাবের এন্ড জুবাইয়ের ফেব্রিক্স এর শ্রমিকরা। তাদের দমন করতে পুলিশের সহযোগিতা নিলে  ৫০ জনের অধিক শ্রমিক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে এ ঘটনায় মামলাও দায়ের করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হরিলুট শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের  প্রতিবেদন নোমান গ্রুপ নামের এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাণিজ্যিক লেনদেনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করলেও সতর্ক হয়নি কোনো ব্যাংক। আর এই সুযোগ নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন নোমান গ্রুপ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। মাত্র ৬৭ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, তিনি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি। বিক্রয়কর্মী হিসেবে রাজধানীর ইসলামপুরে কাপড় বিক্রি শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে শুরু করেন নিজের ব্যবসা। ১৯৮৭ সালে এসে বড় ছেলের নামে গড়ে তোলেন নোমান গ্রুপ। বর্তমানে এ গ্রুপের অধীনে রয়েছে ৩২টি প্রতিষ্ঠান ও কারখানা। এগুলোর মধ্যে- স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, নাতি-নাতনিদের নামেও রয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। কাগজে-কলমে ৩২ প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাস্তবে ৮ থেকে ১০ প্রতিষ্ঠান সচল রয়েছে- বাকিগুলো বিলুপ্ত প্রায় প্রতিষ্ঠান। তারপরও সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছে নোমান গ্রুপ-এমন তথ্য প্রতিবেদকের হস্তগত হয়েছে।  


আরও পড়ুন