রাজউক অসহায় অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধে

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৩-৩-২০২৩ দুপুর ৪:২২

104Views

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না রাজউক। আর অনুমোদিত ভবনের চেয়ে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই অনেক বেশি বলে রাজউক সূত্র জানিয়েছে।

অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিষয়ে মামলা হলেও রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শিথিলতার কারণে ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ভবন নির্মাণে বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। নেপথ্যে অথারাইজড অফিসারদের দুর্নীতি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, রাজউকের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক এক প্রতিবেদন মতে ১৫ হাজার ৯৯৩টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। তার মধ্যে মাত্র ২০৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। ফলে বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের ঘটনাও নগণ্য।এদিকে রাজউক অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি বা ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মো. মনির হোসেন রাজ গং এর নিযুক্ত ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ এর ব্যবস্থা পরিচালক সামছুল হক ফরাজী, ৩১২/৪/এম-১ (মাজেদা ইউনিটি), লালকুঠি (শাপলা হাউজিং সংলগ্ন ) ঢাকা মহানগরীর দারুস সালাম থানা। পূর্ব-কান্দির মোজাস্থিত সি এস দাগ নং-২০ (অংশ) ঢাকা রাজউক স্মারক নং রাজউক /ন অ অ-৩/৩ সি-৭২/১০.৪০৪। গত ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল এর মাধ্যমে মো. মনির হোসেন রাজ গং এর নিযুক্ত আমমোক্তার ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামছুল হক ফরাজীর নামে সাত তলা আবাসিক /এ-টু ইমারতের লে. আউট নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মাণ কাজ করা হয়েছে বলে রাজউকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। 

সূত্রটি আরো জানায়, উল্লেখিত ভবনের সম্মুখ দিকে ন্যূনতম সেটব্যাক এর পরিমাপ ১.৫২ মিটার এর স্থলে ১.০০ মিটার করা হয়েছে। আর বর্ধিত করে তা নির্মাণ করা হয়েছে ১.০০ মিটার। আবার পশ্চাত দিকে ২.৬৪/১.৯৬ মিটারের স্থলে সেটব্যাক ০.৬৪ মিটার এবং বর্ধিক অংশে ২.০০ মিটার করা হয়েছে। তাছাড়া, ডান দিকে ১.৫০ মিটরের স্থলে সেটব্যাক এর কোনো জায়গা না রেখে বর্ধিত অংশে ১.৫০ মিটার রাখা হয়েছে। আর বাম দিকে ২.১৮ মিটারের স্থলে সেটব্যাক রাখা হয়েছে ৭.৭৮ মিটার এবং ১.৪০ মিটার বর্ধিত করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। 
এছাড়াও অনুমোদিত লে. আউট নকশা অনুযায়ী সিঁড়ি, লিফট না রেখে ভবনের অবস্থান পরিবর্তন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আবার উল্লেখিত ভবনের নীচ তলায় আর সামনের দিকে সেটব্যাক এর সাথে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে ভবনটি ৮ তলা (সাত তলার উপরে অর্ধেক অংশে ফ্ল্যাট) নির্মাণ করা করা হয়েছে। এতেই প্রতিয়মান হয়ে যে, উক্ত ডেভেলপার কোম্পানি ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে ইমারত বা ভবন (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের কাজ করা হয়েছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তপূর্বক গত ২০২২ সালের ২৩ জুন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জোনাল অফিস. মহাখালী ঢাকা এর অরাইজড অফিসার-৩-১ স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে উল্লেখিত ভবন নির্মাণের বিষয়ে ব্যত্যয়কৃত অংশ কেন ভেঙে ফেলা হবে না, তা উক্ত ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সামছুল হক ফরাজী এবং মো. মনির হোসেন গং এর কাছে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। আর ওই পত্রের অনুলিপি কপি রাজধানীর দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)’র কাছেও প্রেরণ করা হয়। কিন্তু ওই পত্র প্রেরণের পর রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের অথরাইজড কর্মকর্তাসহ জালিয়াতচক্রের সদস্যরা অনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
রাজউক সূত্র জানায়, রাজধানীতে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৩৫টি ভবনকে চিহ্নিত করেছে রাজউক। আর ঢাকার বাইরে ১২০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোট ১৫৫টি ভবনের বিষয়ে সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে রাজউক চিঠি দিয়েছে। ঢাকার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি ভবনের মধ্যে সূত্রাপুর ও কেরাণীগঞ্জে ২৭টি। আর সাভার ও মিরপুরে ৫টি এবং গুলশান, মহাখালী ও নারায়ণগঞ্জে ৩টি।
গত চার বছর আগে রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে রাজউক এলাকায় ৩২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে। ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি কমিটি রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে ভবনগুলো অপসারণে সময় বেঁধে দেন। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারায় পুনরায় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করেন কমিটি। আর এর সঙ্গে ভবনগুলোর গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। 
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সদস্য আসমাউল হোসেনকে আহ্বায়ক করে মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার ১১ সদস্যের একটি কমিটি ভবনগুলো পুনরায় পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। সিদ্ধান্ত হয়, এই কমিটির তৈরি করে দেওয়া প্রশ্নপত্র ও সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তারা আবারও ভবনগুলো পরীক্ষা করে বর্তমান অবস্থা জানাবেন।
এ বিষয়ে ভবন পুনরায় পরীক্ষার জন্য গঠিত কমিটির আহ্বায়ক আসমাউল হোসেন গণমাধ্যমে বলেছেন, পুনঃপরীক্ষার পর ৩২১টি ভবনের মধ্যে ৩৫টি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও ১০০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এর বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা। আর ২৫টি ভবন মালিক নিজ উদ্যোগে ভেঙে ফেলেছেন। নতুন করে নির্মিত হয়েছে ২৮টি ভবন। ১৩টি ভবনের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। আর মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৫৯টি। আর ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় সাভার ও মিরপুরে ২৫টি, গুলশান ও মহাখালীতে ২০টি, ধানমন্ডি ও লালবাগ এলাকায় ১২টি, মতিঝিল ও ভুলতায় ২০টি এবং নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও সোনারগাঁ এলাকায় আছে ১১টি ভবন।
অপরদিকে রাজধানীর পূর্ব রামপুরা এলাকার বাসিন্দারা গত ৮ জানুয়ারি রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে এক লিখিত অভিযোগ করেছেন। উক্ত অভিযোগে বলা হয়েছে, পূর্ব রামপুরার জাকের রোডস্থ ২৪৮, ২৪৬/২-এ নম্বর ভবনগুলো রাজউকের অনুমোদিত নকশা মতে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে তারা ধারণা করছেন। আর একই অভিযোগ গত ২৬ জানুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। উক্ত অভিযোগে ২৪৬/১, ২৪৭/১ ও ২৪৮/১ ভবনগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
অভিযোগে জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী জোটন দেবনাথ ও তার সহযোগীদের ছত্রছায়ায় অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। 
এ বিষয়ে রাজউকের জোন - ৬ এর অথারাইজড অফিসার প্রকৌশলী জোটন দেবনাথ এর সেল ফোনে একাধিকার বার ফোন করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। পরে তার সহকারী অফিসার আওরঙ্গজেব নান্নু মিয়া ও আমিনুল ইসলামের সেল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রাজউকের আরেক সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে থাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকায় গত ২০০৬-১৬ সাল পর্যন্ত নতুন স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে ৯৫ হাজার। এর মধ্যে অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কেবল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবকাঠামো। এছাড়া, ২০২২-৩৫ সালের জন্য করা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাব) অনুমোদন ছাড়া নির্মিত ভবন বৈধ করতে। এজন্য ড্যাপের আওতায় বিধিমালা প্রণয়নে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। আর ওই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ-১-এর অতিরিক্ত সচিবকে। 
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় শুধু জরিমানার বিনিময়ে বৈধ করা শহরের বাসযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে উৎসাহিত হতে পারে অবৈধভাবে নির্মাণকাজ। তাছাড়া যেসব স্থাপনা অননুমোদিত কিংবা বিধিমালা বা অনুমোদনের শর্ত ভেঙে নির্মিত হয়েছে, তা অপসারণের বিধান বিদ্যমান ইমারত বিধিমালাতেই রয়েছে। ফলে বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো ধরনের ব্যত্যয় বহাল রেখে জরিমানার মাধ্যমে সেই স্থাপনা বৈধ করার সুযোগ নেই। 
একজন নগর পরিকল্পনাবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কয়েকদিন আগে তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে, জরিমানা দিয়ে যেসব অবৈধ ভবন বৈধ করা সেগুলোই বিধ্বস্ত হয়েছে। এজন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাদেরও বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ছোট একটি সিদ্ধান্ত যেন বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।’

 


আরও পড়ুন