স্টেশন দখলসহ খোয়া যাচ্ছে রেলের মূল্যবান যন্ত্রাংশ

news paper

মুহা. ফখরুদ্দীন ইমন, চৌদ্দগ্রাম

প্রকাশিত: ২৫-১-২০২৩ বিকাল ৫:৭

15Views

তিস্তামুখ-বালাসীঘাট রুটে প্রায় ২২ বছর ধরে বন্ধ রেলওয়ে ফেরি ও ট্রেন সার্ভিস। সে কারণে তিস্তামুখ রেলওয়ে স্টেশন, ভরতখালী স্টেশন, বালাসীঘাট রেলওয়ে স্টেশন, কঞ্চিপাড়া স্টেশন ও আনন্দবাজার রেল স্টেশনটি বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তিস্তামুখঘাট, ভরতখালী স্টেশন ও বালাসী-ত্রিমোহিনী রেলপথটি বছরের পর বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকায় রেলের জমি দখল, কাঠের স্লিপার, রেলপাত, নান্টুবল্টুসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হওয়াসহ নষ্ট হচ্ছে রেলের সম্পদ।রেলওয়ে সুত্র জানায়, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদঘাট দিয়ে যমুনা নদীতে রেল ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। তৎকালীন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর জেলার গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগর ও ঠাকুরগাঁও জেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের জন্য যোগাযোগ গড়ে তুলতেই এ ফেরি সার্ভিসটি চালু করা হয়।
১৯৯০ সালে যমুনা নদীর নাব্য সংকটে ফেরি সার্ভিসটি তিস্তামুখঘাট থেকে একই উপজেলার কঞ্চিপাড়ার বালাসীঘাটে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থানান্তর করা হয়। ত্রিমোহিনী স্টেশন থেকে বালাসী পর্যন্ত নতুন করে রেলপথ নিমার্ণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করত এতদাঞ্চলের মানুষ। এছাড়াও সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া হয়েও ট্রেনে এ ঘাট দিয়ে মানুষ চলাচল করত। তবে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর থেকে যাত্রীবাহী লোকাল, মেইল ট্রেন ও আন্তঃনগর একতা, তিস্তা, করতোয়া ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বালাসীঘাট চালুর পরপরই নির্মিত হয় বঙ্গবন্ধু সেতু। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এ রুটটি। তিস্তামুখ ফেরিঘাটও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করে যাত্রী পারাপার ব্যবস্থার চুড়ান্ত ইতি টানা হলে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারীর লোকজন যমুনার পূর্বপাড়ের জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুরের বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে রেল যোগাযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।২০০০ সাল নাগাদ রেলওয়ে ফেরি সার্ভিসের জন্য যে ৩৪টি নৌবহর ছিল তার মধ্যে ৩টি ছিল প্যাসেঞ্জার স্টিমার, ৫টি টাগ, ৫টি ওয়াগন-ফেরি বার্জ, ৬টি পল্টুন র‌্যাম্প এবং ১৫টি ফ্লাট। এর মধ্যে, নৌযান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১টি ভাসমান নৌযান মেরামত কারখানা ছিলো। বন্ধ ঘোষণা ও নিয়মিত ডগিং না হওয়ায় অকার্যকর হয়ে পড়ে জাহাজগুলো। শত শত কোটি টাকার এসব জাহাজ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। 
এ ব্যাপারে বালাসীঘাট রেলওয়ের মেরিন সুপারিনটেনডেন্ট (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রাসেল আলম জানান, পর্যায়ক্রমে ফেরিঘাটের স্থাপনা ও অকেজো মালামাল বিক্রি করা হচ্ছে। বাকিগুলোও বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। যাতে জাহাজ ও ফেরিঘাটের সম্পদ নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছেন তারা। ফেরি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিভিন্ন বিভাগে বদলি করে কাজে লাগানো হচ্ছে। মালামাল পাহারা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বালাসীঘাটে কিছু কর্মচারী আছে সম্পূর্ণরূপে স্থাপনা সমূহ বিক্রি হয়ে গেলে বাকিদেরও রেলের বিভাগে বদলি করা হবে।রেলওয়ে যাত্রী ও ফুলছড়ি বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী হাসান আলী জানান, তিস্তামুখ ঘাট থেকে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে অল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে ময়মনসিংহ, ঢাকয় যাতায়াত করা যেত। কিন্তু ফেরি ও ট্রেন বন্ধ থাকায় বোনারপাড়া অথবা গাইবান্ধা জেলা শহরের গিয়ে বাস/ট্রেনে দিগুন ভাড়া ও দীর্ঘসময় অপচয় করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তিস্তামুখঘাট কেন্দ্রিক সে সময়ের শ্রমিক বাবলু শেখ বলেন, ফেরি ও ট্রেন বন্ধ হওয়ার কারণে এ এলাকার হাজারো কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়েছে। তাদের খুব কষ্টে দিন কাটছে। আর রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান রেলওয়ের লোহার পাত। কিন্তু সেদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কোন নজর নেই। ভরতখালী রেল স্টেশনের বাসিন্দা শাহদত হোসেন জানান, আবাদযোগ্য ভূমি চাষাবাদের অভাবে যেমন পরিত্যক্ত হয়ে যায় এ স্টেশনের অবস্থাও তাই হয়েছে। মাদকসেবী আর অসামাজিক কার্যকলাপে কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে স্টেশনটি। তিস্তামুখ ঘাট এলাকার বাসিন্দা আলমঙ্গীর হোসেন জানান, তিস্তামুখঘাট থেকে ১টি শার্টল ট্রেন যদি চালু করা যেত তাহলে এ অঞ্চলের মানুষ বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশনে গিয়ে যেকোন আন্তঃনগর ট্রেনে রাজধানী ঢাকায় সহজে যাতায়াত করতে পারতো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পশ্চিম জোনের আওতাধীন গাইবান্ধার বোনারপাড়া-তিস্তামুখঘাট ও ত্রিমোহনী-বালাসীঘাট রেলরুটের লাখ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ ও ভূসম্পত্তি প্রতিদিন চুরি হচ্ছে। রেল কর্তৃপক্ষ তাদের লোকজন গুটিয়ে নেওয়ায় এই দুই রুটের প্রায় ২৫ কিমি রেললাইনের মধ্যে অবস্থিত ত্রিমোহনী আর বালাসীঘাট রেলস্টেশন এখন অসামাজিক কার্যকলাপের আখরায় পরিণত হয়েছে। এ রেলপথের অসংখ্য স্থানে কাঠের স্লিপার পঁচে নষ্ট ও রেল ব্রিজের কাঠের স্লিপার চুরি হয়ে যাচ্ছে। বালাসীঘাট ও আনন্দবাজার রেল স্টেশনের টিনের তৈরি ঘর ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন তিস্তামুখঘাট, ভরতখালী রেল স্টেশন, বালাসী-ত্রিমোহিনী রেলপথে শুধু রেললাইন ছাড়া আর কিছুই নেই। এছাড়াও বোনারপাড়া-তিস্তামুখঘাট ও ভরতখালী রেলস্টেশন এলাকার প্রায় ২শ’ একর ভূসম্পত্তি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ভরতখালী থেকে তিস্তামুখঘাটের প্রায় হাফ কিলোমিটার রেললাইনের উপর গড়ে তোলা হয়েছে, বিএনপি অফিস, মুক্তিযোদ্ধা অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়িসহ নানা রকমের স্থাপনা। প্রসঙ্গে ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলোম জানান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় অফিস ঘর নিমার্ণ করা হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যখন ছেড়ে দিতে বলতে আমরা তখনে আমাদের অফিস ঘর সরিয়ে নিবো। তবে শুধু আমাদের নয়, অবৈধভাবে যারা দখল করে বসবাস অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অনেকেই আবার অফিস খুলে বসে আছে তাদেরকেও উচ্ছেদ করতে হবে।দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার এ রেলরুট অরক্ষিত হয়ে পড়ে থাকায় রেলস্টেশনের ভবনগুলো পরিণত হয় জুয়াড়ি, মাদকসেবী ও অপরাধীদের নিরাপদ আখড়ায়। দীর্ঘ এই শাখা লাইনটির আশপাশে রেলের প্রায় তিন’শ একর ভূমির মধ্যে রয়েছে পুকুর, ফসলি জমি, বাণিজ্যিক প্লট ও এলাকার মৌসুমি বাজার। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এসব মূল্যবান সম্পত্তির মাঝ থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ২শ’ একর জমি দখল করে নিয়েছে। রেলের জায়গা দখলকারী কয়েক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে মাসিক ভাড়া দিতে হয় রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। আবার মাঝে মধ্যে রেল কর্তৃপক্ষ মাইকে প্রচার করে অবৈধ দখলদারদের রেলের জায়গা ছাড়ার নিদের্শ দেয়। তখন চাঁদা তুলে প্রয়োজনীয় অর্থ দিলেই উচ্ছেদের কোনো ভয় থাকে না।এ ব্যাপারে লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ জানান, নাব্যতা সংকটের কারণে তিস্তামুখঘাটটি বালাসীঘাটে স্থানান্তর করা হলে ত্রিমোহনী রেল স্টেশন থেকে বালাসী পর্যন্ত তিনটি রেল স্টেশ স্থাপন করা হয়। এবং পূর্বের তিস্তামুখ রেলওয়ে স্টেশন ও ভরতখালী স্টেশনটি একেবারে বন্ধ হয়ে আছে। বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট নৌ-টার্মিনাল নিমার্ণ করা হয়েছে। সেখানে ফেরি সার্ভিল চালু হলে রেল ট্রেনের দরকার নেই। সে কারণেই স্টেশগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশন থেকে তিস্তামুখঘাট পর্যন্ত একটি শার্টেল ট্রেন চালুর নির্দেশ যদি রেল মন্ত্রানালয় থেকে আসে সেক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে ট্রেন চালু করা সম্ভব। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশল বিধি মতে, রেলপথের দু’ধারে খালি জায়গা থাকা আবশ্যক। কমপক্ষে ১৪.৩ ফুট এবং সর্বোচ্চ ৩০ ফুট জায়গা খালি রাখতে হয় পাশে নিরাপদ দূরত্ব হিসেবে। এরমধ্যে কোনো স্থাপনা তৈরি করলে বিনা নোটিসে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। অথচ পশ্চিম জোনের রেলপথের দুপাশ ঘেঁষে শত শত স্থাপনা বিদ্যমান। জবরদখলকৃত জমি উদ্ধারে রেলের রয়েছেন বিভাগীয় এস্টেট অফিসার, সহকারী এস্টেট অফিসার, সার্কেল অফিসার, কানুনগো। রেলভূমি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত রয়েছে প্রকৌশল বিভাগ। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে লালমনিরহাট ডিভিশনাল এস্টেট অফিসার ও সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ সুজাউদ্দৈীলা বলেন, অবৈধ দখলের বিষয়ে অবহিত করলে তখন উচ্ছেদ অভিযানের ব্যবস্থা নেয় ভূ-সম্পত্তি বিভাগ। এই বিভাগটির রয়েছে জনবল সংকট, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট। ফলে বড় ধরণের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় স্থবিরতা বিরাজ করছে।


আরও পড়ুন