রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণের

news paper

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ১৫-১-২০২৩ রাত ৮:৩৫

9Views

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের আমলকে। রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণ। জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদ যেন কেউ ব্যহত না করতে পারে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরী। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অভিযাত্রায় যেন কোন অপশক্তি বাধা না হয়ে দাড়ায়। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই উন্নয়ন বলা হয়ে থাকে। এ প্রবৃদ্ধি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশের আর্থসামাজিক ও সামষ্ঠিক গতিশীলতাকে যখন দূর্নীটি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে গ্রাস করা হয় তখন সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয় সাধারন জনগণ।

সাম্প্রতিক সময়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবায়দা রহমানের সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের মামলায় তারেক ও তার স্ত্রী জোবায়দার বিরুদ্ধে নভেম্বর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। সম্প্রতি আদালতে প্রতিবেদন এসেছে-তারেক ও তার স্ত্রী পলাতক। এ নিয়ে আদালত ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পলাতক আসামির সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তদরুপ, দূর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারনে এ আদেশ জারি হয়। 

দেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির কারণে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই) এ বাংলাদেশে পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমল ছিল সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দুর্নীতিপরায়ন এই সরকারের শাসনামলে খুব একটা প্রকাশিত না হলেও ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্ববাধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিকে বিএনপির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং সার্বিক সমর্থন দেওয়ার খবর প্রকাশিত হতে থাকলে খালেদা জিয়া, তার ছেলে ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। বেরিয়ে আসতে শুরু করে তাদের সকল দূর্নীতি-সন্ত্রাসী কার্যক্রম। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজপ্রাসাদ তৈরি হয়েছিল তারেকের নিয়ন্ত্রণাধীন হাওয়া ভবন। তারেকের সকল অপকর্মের সাক্ষী হয়ে আছে এই হাওয়া ভবন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায়  ২২ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়। ওই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি থেকে তারেকের জড়িত থাকার প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। মুফতি হান্নান জানায় তারেকের নির্দেশেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য  জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে  হাওয়া ভবনে  একাধিকবার বৈঠক করে বিএনপি রাজপুত্র খ্যাত তারেক জিয়া। ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট জঙ্গি সংগঠন জেএমবি সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে বোমার বিম্ফোরণ ঘটায়। ওইদিনের ঘটনায় দু’জন নিহত এবং অর্ধশত আহত হন। পরবর্তী সময়ে জেএমবির আরো কয়েকটি বোমা হামলায় বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জন নিহত হয়। জেএমবির এসব হামলা মূলত তারেক ও বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই হয়েছিল।তারেকের পরোক্ষ মদদে ২০০৬ সালের ৪ জুলাই বসুন্ধরা গ্রুপের প্রকৌশলী সাব্বির খুন করা হয়। পরবর্তীতে সাব্বির হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামীদের বাঁচাতে এবং এই হত্যা মামলা ধামাচাপা দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছিলো তারেক ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর।সৌদি আরবে তারেক জিয়া ১২০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার করেছে। এই অর্থ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ জঙ্গী ও মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবহৃত হতো।এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর নামে বিদেশ থেকে থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাত  করেছিলেন তারেক ও তার মা খালেদা। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর টেলিভিশনে ভাঙা স্যুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জি দেখানো হয়। তাকে সততার মূর্ত প্রতীক বানানো হলো। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, জিয়া পরিবার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। লঞ্চ, টেক্সটাইল মিলস, বিদেশে বাড়ি, ব্যাংক-ব্যালান্স- এগুলো হঠাৎ কোথা থেকে এলো? সততার মুখোশ পরিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে সহানুভূতি আদায় করা হয়। হঠাৎ করে এত টাকার মালিক হলো কীভাবে? পুরো জিয়া পরিবার, অর্থাৎ খালেদা জিয়া, তারেক, কোকো সবাই শুধু অসৎ নয়, তারা চরম দুর্নীতিবাজ, জিঘাংসাপরায়ণ, ক্ষমতালোভী। আদালতে খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলের দুর্নীতির প্রমাণ হয়েছে এবং সাজা হয়েছে। তারা শুধু দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার মালিক হয়েই ক্ষান্তহয়নি, সেই টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

জামাতকে পূর্ণবাসনের জন্য তারেক জিয়ার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ও নির্বাচনে জয়লাভে কৌশলগত বুদ্ধির প্রয়োগের কৃতিত্ব তার। হাওয়া ভবন নামে একটি বাসা থেকে তিনিই মূলত সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল তার ছায়া সরকার এ গুলো ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক জোট দীর্ঘদিনের। তবে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াতকে ছাড়ার সিদ্ধান্তনেয় কমিটির একাংশ। তবুও রহস্যজনক কারণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এজন্য তারেক রহমান স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে জোট ভাঙতে অসম্মতি জানিয়েছেন। জানা গেছে, বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম কিংবা সংগঠনের স্থবিরতা প্রতিরোধে জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পান দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সঙ্গে জোট বাধে বিএনপি। শুধুমাত্র জামায়াতের পেশিশক্তি ও অর্থ ব্যবহারের নামে বিরোধীদল দমনে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গী করেন খালেদা জিয়া। এখনো ক্ষমতায় যেতে জামায়াতের প্রলোভনে পড়ে আছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। সেই জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে নানা আলোচনা হলেও অদৃশ্য কারণে দলটিকে ছাড়ছে না বিএনপি। বিএনপি যার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা হয় সেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের ব্যবহার করে অবৈধভাবে তিনি হন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের এই ইতিহাসের চর্চা শুরু জিয়াউর রহমানের হাত ধরে, যা পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেন এরশাদ। জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তার সময় বাংলাদেশে গড়ে ওঠা এই দুর্নীতির চক্র কার্যকর ছিল জিয়া হত্যার পরও। তাদের হাত ধরেই ক্ষমতায় আসেন বেগম জিয়া। কিন্তু চারদলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে দুর্নীতি অনেকটা শিল্পের পর্যায়ে চলে যায়।

জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা, দেশকে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করার অপচেষ্টা, শত শত রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে মদদদান, কণ্ঠরোধ ও দলীয় কর্মীদের দ্বারা বিরোধী মত দমনের জন্য নির্লজ্জভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, ব্যক্তিস্বার্থে দেশের প্রতিটি খাতকে ধ্বংস করে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া সহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখানে তারেক রহমান জড়িত ছিল না। শুধু জিয়া পরিবারের পাঁচ বছরের দুর্নীতির উপাখ্যান লিখলে তা মহাকাব্য হয়ে যাবে। আমাদের সচেতন নাগরিকদের বিবেচনা করা উচিত এতসব তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও তারেক রহমানের মতো একজন চিহ্নিত ও প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ কীভাবে দেশের দ্বিতীয় দলের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন! ভেবে দেখা উচিত কোন বিবেচনায় এবং কোন মানসিকতার মানুষদের কাছে তারেক রহমান দেশনায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। দেশের অগ্রযাত্রাকে উল্টোপথে ধাবিত করে ও জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করে রাজনৈতিক র্দুবৃত্তায়নের নায়করা যদি দেশনায়ক বলে গণ্য হয় তাহলে অন্ধকার ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণের রাজপুত্রদের নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। করোনার টীকাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জন করেছে। দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানিক দূর্নীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে আর কখন ও জনগণের সম্পদকে যেন ছিনিমিনি না খেলতে পারে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। 


আরও পড়ুন