কোর্টের দিকে তাকিয়ে দুদক

news paper

সাজেদা হক

প্রকাশিত: ২২-১২-২০২২ দুপুর ১:১০

11Views

সাম্প্রতিক সময়ে বহু ঘটনায় দেখা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ  অভিযোগ দেয়ার পর, সেই অভিযোগের কি পরিণতি হলো তা জানতে পারেন না অভিযোগকারী। আবার ২/৩ মাস পর একই অভিযোগ নিয়ে আদালতে উপস্থিত হলে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সেই অভিযোগটি অনুসন্ধান করার নির্দেশ দিচ্ছেন আদালত।  তখন আদালতের নির্দেশে অভিযোগটির অনুসন্ধানে নামছে দুদক। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধান শুরুর জন্য আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকছে দুদক। আবার কখনও কখনও কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করলেও তা আর শেষ হচ্ছে না, বছরের পর বছর পরে থাকছে। ফলে আদালতে নিয়মিতই বাড়ছে দুদকের মামলা এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতা। 

ঘটনা ১: সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধান গতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। কোনও ব্যক্তিকে নোটিশ দেওয়ার পর, তা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখায় এই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এমন ঘটনায় দুদকের অনুসন্ধানের কাজ এক্সপ্রেস গতিতে নয়-কচ্ছপ গতিতে চলে বলে মন্তব্য করে আদালত। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতি অনুসন্ধান বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দেওয়া চিঠি নিয়ে জারি করা রুলের শুনানিকালে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।

এই সময় দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ২০১০ সালের ঘটনা, তখনই সুপ্রিম  কোর্টের কাছে তথ্য চাইতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সাত বছর পর  কেন দুদক তথ্য চাইলো। দুদকের অনুসন্ধানের কাজ এক্সপ্রেস গতিতে নয়, কচ্ছপ গতিতে চলে। ৯ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া চিঠি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। এরপর গত ১৯ অক্টোবর রুলের ওপর প্রথম শুনানি হয়। গত ২৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া চিঠিটি হাইকোর্টের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামান তফাদার। এরপর আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। 

ঘটনা ২: এর আগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদককে তিন মাস সময় বেঁধে দেন আদালত। ২১ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ওসি মনিরুল ইসলামের রাজধানীতে আট তলা বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান চেয়ে আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের রিট নিষ্পত্তি করে আদালত এ আদেশ দেন। শুনানিতে আদালত অভিযোগ বিষয়ে রিট আবেদনকারীকে আবেদন দিতে বলেন দুদককে। রিটের শুনানি ২১ আগস্ট পর্যন্ত মূলতবি করেন আদালত। এর ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট বিষয়টি আদালতে ওঠে। অন্যদিকে, ওসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধান নিয়ে রিট আবেদনকারী ১১ আগস্ট দুদকে আবেদন দেন। এর ফলে ওসির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করার বিষয়ে ১৭ আগস্ট দুদক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আদালতকে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এরপর অভিযোগের অনুসন্ধান তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দিয়ে আদালত রিটটি নিষ্পত্তি করে দেন।

আদালতে রিটের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক, দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান, ওসির পক্ষে আইনজীবী মাহবুব শফিক ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে ছিলেন।

ঘটনা ৩: এদিকে, খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।  দুদক চেয়ারম্যান বরাবর করা আবেদনে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, সালাম মুর্শেদীর গুলশানের বাড়িটি পরিত্যক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত। ওই বাড়ি সালাম মোর্শেদী দখল করে বসবাস করছেন। বিষয়টি নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে ১৫ ও ১৬ সালে জানতে চাইলেও কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। এছাড়া ওই জমি নাম জারি ও দলিলের বিষয়ে জানতে  চেয়ে ৪ জুলাই রাজউকে আবারও চিঠি দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এখনো যার জবাব মেলেনি বলে আবেদনে উল্লেখ করেন তিনি।  এমপি হওয়ার সুযোগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা রাজউকের সহায়তায় আবদুস সালাম মোর্শেদী ওই বাড়ি দখল করে রয়েছেন বলে মনে করেন ব্যারিস্টার সুমন। তাই বিষয়টি অনুসন্ধান করে আবদুস সালাম মোর্শেদী এবং রাজউক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন তিনি। এর আগে শুনানিতে ব্যারিস্টার সুমনকে উদ্দেশ্য করে হাইকোর্ট বলেন, আপনার মনোভাবের সঙ্গে আমরা শতভাগ একমত। দুদকে একটি আবেদন করুন। দুদক যদি ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আমরা দেখব। 

ঘটনা ৪: অন্যদিকে, ঢাকার উত্তরার আজমপুর অংশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সরকারি জমি বন্ধক রেখে বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করতে ৩ মাসের সময় বেঁধে  দেয় হাইকোর্ট। দুদককে এ নির্দেশ পালন করতে বলা হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি শুনানিতে কী কারণে ভুয়া ডকুমেন্টে ঋণ দেওয়া হয়েছিলো সে সম্পর্কে জানাতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) জবাব দাখিল করতে বলেছিল হাইকোর্ট।

এছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জমি বন্ধক রেখে দুর্নীতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট বিবাদীদেরকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিলো। ২৪ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট  বেঞ্চ এসব আদেশ দেন। আদালতে বিএফআইইউ'র পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহীন আহমেদ।

ঘটনা ৫: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১৭ সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ৮ মাসের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পরিচালনা করে যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আদেশে বলা হয়েছে। এছাড়া ৮ মাস পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে দুদককেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো.  মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মারসেদ। অন্যদিকে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফৌজিয়া আক্তার পপি এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ  কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, অভিযোগ ওঠা ১৭ জন সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে দুদক যে অনুসন্ধান করেছে, তা সঠিক হয়নি। দুদকের পরিপত্র অনুযায়ী যেভাবে অনুসন্ধান করতে হয়, সেভাবে তারা করেনি। তাই তাদের বিরুদ্ধে পুনরায় অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ বিমানের ১৭ সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয় তদন্তের জন্য নোটিশ দেয় দুদক। দুদকের পক্ষে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। পরে এ ঘটনায় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর সেসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে জনস্বার্থে হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। সে রিটের শুনানি নিয়ে ওই ১৭ জনের ক্ষেত্রে দুদকের পদক্ষেপে নিস্ক্রিীয়তা কেন বে-আইনি ঘোষনা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত। গতকাল ওই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দুর্নীতিমুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে  আয়োজিত সেমিনার এবং মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। তাই সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকতাদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের উন্নয়ন কতিপয় দুর্নীতিবাজদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে  রাষ্ট্্রপতি বলেন, দুর্নীতিবাজদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, উপস্থিত ছিলেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ, দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান, দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক, দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারি।  

সাধারণ মানুষের মনে দুর্নীতি দমন নিয়ে যাতে বিরূপ মনোভাব তৈরি না হয় সেজন্য দুদক এসব ঘটনার আলোকে কোন মন্তব্য করবেন কি না জানতে যোগাযোগ করা হয়। দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। 


আরও পড়ুন