অর্থ পাচার ঠেকাতে সিআইডির উদ্যোগ 

news paper

সাজেদা হক

প্রকাশিত: ২৭-১১-২০২২ বিকাল ৬:২

34Views

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন জাতীয় সংসদে পাস হয় ২০০২ সালে। পরে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২’ বাতিল করে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০০৮’ জারি করা হয়। ওই সময় ১৭টি অপরাধের সবই দুদক তদন্ত করত। পরে আবার অধ্যাদেশটি বাতিল করে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯’ পাস করা হয়। ওই সময়ও সব ধারা দুদকের তফসিলভুক্ত করা হয়। 

পরে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর আইন পরিবর্তন করে এ ক্ষেত্রে ২৭টি অপরাধের মাত্র একটি দুদককে দেওয়া হয়। বাকিগুলো দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে। বর্তমানে সাতটি সংস্থা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সাত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

শুরু থেকেই সিআইডি মুদ্রা জালকরণ, দলিল দস্তাবেজ জালকরণ, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটকে রাখা ও পণবন্দী করা, খুন মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি, নারী ও শিশু পাচার, চুরি বা ডাকাতি বা দস্যুতা বা জলদস্যুতা বা বিমান দস্যুতা, মানব পাচার, যৌতুক, মেধাস্বত্ব লংঘন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ জোগান, ভেজাল বা স্বত্ব লংঘন করে পণ্য উৎপাদন, সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ অনুসন্ধান, তদন্ত শেষে মামলা দায়ের করার ক্ষমতা রাখেন।

 আর যৌথভাবে সিআইডি চোরাচালানী ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে, পরিবেশগত অপরাধের তদন্ত/অনুসন্ধান পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথভাবে পরিচালনা করে সিআইডি। এছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ কাস্টমসের সাথে যৌথভাবে  চোরাই ও অন্যান্য  দ্রব্যের ব্যবসা, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসার তদন্ত/অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে সিআইডি।
 
দায়িত্ব প্রাপ্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৬০০ অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এসব অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত শেষে মামলায় গড়িয়েছে ৩৫০টি, চার্জশীট দেয়া হয়েছে ২৫০টি অভিযোগের এবং এখনও তদন্ত চলছে ১০০টির মতো অভিযোগের বলে জানিয়েছেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ন কবীর। যৌথভাবে পরিচালিত কার্যক্রমের ভিত্তিতে কাস্টমসের ২১ মামলা, ক্যাসিনো সংক্রান্ত ১৩ মামলা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ১৭ মামলা এবং ই-কমার্সের আওতায় প্রায় ১১টি মামলা দায়ের করে পুলিশের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ এই চৌকষ টিম। 

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ন কবীর জানান, ২০১৫-২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৩১টি মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করা হয়েছে। তারমধ্যে ১৯৬টি মামলায় অভিযোগপত্র এবং ৩১টি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিলসহ মোট ২২৭টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এখনো ১০৪টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়াও ৪৭৭টি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান শেষে ৩৪৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং বর্তমানে ১৩২ টি অনুসন্ধান চলমান। 

উল্লেখযোগ্য সাফল্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হতে হ্যাকিং এ মাধ্যমে চুরি করা ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এর মধ্যে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকা হতে ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এরিমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। 

একই সাথে ঢাকার ক্লাবপাড়া কেন্দ্রিক ক্যাসিনো সম্পৃক্ত মানিলন্ডারিং মামলা সংক্রান্ত মোট ১৩টি মামলা রুজু করা হয়। ১১টি মামলায় এরিমধ্যে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বাকি ২টি অর্থপাচার মামলা এমএলএআর প্রাপ্তি সাপেক্ষ নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। এসব মামলা থেকে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সিআইডির এই চৌকষ টিম। যা রাষ্ট্্রীয় কোষাগারে জমা ও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। প্রায় ৪১০ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়াও আসামিদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ বিঘা জমি, ২টি বাড়ি, ১৩০টি ফ্লাট, ১৫টি গাড়ী এবং ১০ মোটর সাইকেল উদ্ধার করেছে। 

এছাড়াও প্রশ্নপত্র ফাঁসসংক্রান্ত মানিলন্ডারিং মামলায় অনুসন্ধান শেষে ৩টি মামলা দায়ের করেছে সিআইডি। ১টি মামলায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অন্যদুটি মামলা এখনো তদন্ত চলছে। 

একইসাথে এহসান গ্রুপ, চলন্তিকা যুব সোসাইটি ও ফারইস্ট ইসলামি মাল্টি কো-অপারেটিভ লিমিটেড নামে ৩টি বড় বড় এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা থেকে প্রায় ৩০০০ শতক জমি, ৩টি বিলাসবহুল বাড়ি, ১০টি অফিস ভবন বিজ্ঞ আদালতের আদেশক্রমে ক্রোক করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 

গত বছর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ২(ঠ) ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯-এর তফসিলে বর্ণিত অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য নির্ধারিত সংস্থার তালিকার সংশোধন চেয়ে আবেদন করে দুদক। নিদেনপক্ষে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ক্রমিক ৩, ৫, ৬, ১৪, ১৮, ১৯ ও ২৫ ধারার ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা চায় তারা। পরে মানি লন্ডারিং প্রতরোধ আইনের ধারায় পড়ে এমন সব ধরনের সংঘটিত অপরাধের তদন্ত দুদক করতে পারবে বলে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে রায় দেন হাইকোর্ট। ফলে একাধিক রায়ে বলা হয়-দুদক মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত যেকোনো অপরাধ তদন্ত করতে পারবে। এতে আইনে কোনো বাধা নেই।

 


আরও পড়ুন