অতিথি পাখি শিকার বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি

news paper

সুকান্ত দাস

প্রকাশিত: ২৪-১১-২০২২ দুপুর ৪:২৪

48Views

উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ভেসে শীত চলে এসেছে। সেই সাথে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। শীতকালে সাইবেরিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর তুষার পাত হয়।সব কিছু বরফে চাপা পড়ে।   এসময় এসব অঞ্চলে পাখিদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।তীব্র খাদ্য সংকট তৈরি হয়।ফলে পাখিরা প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ সহ নাতিশীতোষ্ণ দেশ বা অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে।বিশেষ করে অক্টোবরের শেষ এবং নভেম্বরের শুরুতে এসব পাখিরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে।বিল-ঝিল গুলো  পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠে।ডাহুক,তীরশুল,নলকাক,ভাড়ই,রাংগাবনী,গাংচিল, রাতচড়া,হুটটিটি,হারগিলা,বালিহাঁস, সরালি কাস্তে,হুরহুর সহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে।

কিছু অসাধু মানুষ প্রতিবছর এই অতিথি পাখি শিকার করে থাকে। শীতকালে পাখির চাহিদা থাকে প্রচুর। সাদা বকের জোড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা,বালিহাস ৪৫০  থেকে ৬০০ টাকা জোড়া সহ আকার ভেদে বিভিন্ন পাখি বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়।একারণে পাখি শিকারীরা শীতকালে বেশি বেশি পাখি শিকার করে। অনেকে এই কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। বিভিন্ন ভাবে পাখি শিকার করা হয়। পাখির চলার পথে ফাঁদ পেতে, চোখে আলো ফেলে,কেঁচো দিয়ে বরশি পেতে,কারেন্ট জাল পেতে, বন্দুক দিয়ে, বিষটোপ দিয়ে  পাখি শিকার করে শিকারীরা। অনেকে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। বিশেষ করে ভোর এবং রাতের বেলা পাখি শিকার করা হয়।দিনের বেলা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করে শিকারীরা।অতিথি পাখি শিকারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাখির ডাকের সাথে মিলিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে  বাঁশির সুর তৈরি করে। শিকারীরা ফাঁদ পেতে এই বাঁশি বাজায়।এতে পাখিরা সেখানে উড়ে আসে এবং শিকারীদের পাতা ফাঁদে আঁটকা পড়ে। এখন আমন ধান ঘরে তোলার সময়।অনেক কৃষক ধান কাটার পর জমিতে ফাঁদ পেতে রাখে পাখি ধরার জন্য।

বর্তমানে বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য ড্রেন বা খোলা জায়গায় ডাস্টবিনে ফেলা হচ্ছে।পাখিরা সেই বর্জ্য থেকে খাবার গ্রহণ করার ফলে পাখিদের মধ্যে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হচ্ছে। আবার সেই পাখি শিকার করে যারা পাখির মাংস খাচ্ছে তারাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর অতিথি পাখিরা তো তাদের পূর্বের আবাস্থলে থাকাকালীন বর্জ্য  থেকে যদি রোগাক্রান্ত হয় এবং এখানে আসার পর সেই পাখি শিকার করে খাওয়া হয় তাহলে সেই মাংস থেকে অজানা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। তাই পাখি শিকার  করে মাংস খাওয়া কোনভাবেই করা উচিত নয়।
হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসব পাখিরা আমাদের দেশে আসে বাঁচার জন্য, কিন্তু এখানে এসেও শেষ রক্ষা হয় না তাদের। কিছু অসাধু মানুষের পেট পূজোর সামগ্রী হতে হয়।পাখি হলো প্রকৃতির অলঙ্কার। জলচর পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত  বাংলাদেশে ২৮ টি জায়গা রয়েছে। বরিশালের চরকারি,চর বাঙ্গের,কবলাকিনির চর,চর শাহজালাল, টাবরার চর,ডবা চর,গাগোরিয়া চর,চর গাজীপুর, কালপুর চর,চর মনপুরো,পাতার চর ও উড়ির চর।চট্টগ্রামের চর বারী,বাটা চর,গাউসিয়ার চর,মৌলভীর চর,মুহুরী ড্যাম,মুক্তাদিয়া চর,ঢাল চর,নিঝুম দ্বীপ,পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ,সিলেটের আইলার বিল,ছাতিধরা বিল,হাইন হাওড়,হাকালুকি হাওর, পানাবিল,রোয়াবিল,শনির বিল ও টাগুয়া। অতিথি পাখির সবথেকে বড় আশ্রয়স্থল হলো হাওর, বাওর,জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক গুলোর মতো জলাভূমি।

নির্বিচারে পাখি শিকারের ফলে অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।মানুষের বিরূপ আচরণের শিকার হয়ে সপ্তদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। নির্বিচারে বনভূমি উজাড়, জলাশয় ভরাট, পাখি শিকার এবং পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় নানা জাতের পাখি যেমন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তেমনি অতিথি পাখির আগমনও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। তাই অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে।তা নাহলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।

বণ্যপ্রাণী ও অতিথি পাখি সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক আগে থেকেই আইন রয়েছে  ব্রিটিশ আমলেও বিশেষ আইন ছিলো।The wild birds and Animals protection Act,1912; The Bengal Rhinoceros   preservation Act,1932 তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৪ সালের বণ্যপ্রাণী রক্ষা আইন এবং ২০১২ সালের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল, এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড।  আবার কোনো ব্যক্তি পরিজায়ী পাখির ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি, মাংস,দেহের অংশ সংগ্রহ করলে,ক্রয় বিক্রয় করলে বা পরিবহন করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।   কিন্তু নির্মম সত্যি হলো এসব আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না। যার ফলশ্রুতিতে পাখি শিকার বন্ধ হচ্ছে না।প্রশাসনের উচিত পাখি শিকার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ করা।

অতিথি পাখিরা নামেই শুধু অতিথি। অতিথির কোন মর্যদা এরা পায় না।উল্টো নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এরা আমাদের দেশে এসে প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে কিন্তু আমারা তার প্রতিদান স্বরূপ তাদের হত্যা করছি।অতিথিকে হত্যা না করে অতিথির মর্যাদা দেওয়া উচিত। গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখিরা গাছে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড় ধরে খায়।এতে গাছ ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা পায়।   অতিথি পাখি আমাদের দেশের অনেক বড় একটি সম্পদ।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য শিকারীদের ভয়াবহ ছোবল থেকে মুক্ত হতে পারছেনা পাখিরা।পাখি নিধনের কারণে একদিকে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে ফসলী জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে না ভারসাম্যও রক্ষা করে। পোকামাকড় খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে,পরোক্ষভাবে উৎপাদন বাড়ায়।

দিন দিন অতিথি পাখির আগমন আমাদের দেশে কমে যাচ্ছে।পাখি ও পরিবেশ বিষয়ক এক সমীক্ষায় দেখা যায় বিগত ৫ বছরের তুলনায় আমাদের দেশে অতিথি পাখির সংখ্যা কমেছে শতকরা ৪০ শতাংশ।   যতই আইন থাকুক না কেনো  জনসাধারণের সচেতনতা ব্যাতিত পাখি শিকার বন্ধ করা অসম্ভব।শুধুমাত্র প্রশাসন একা পাখি শিকার বন্ধ করতে পারবে না। জনসাধারণের ঐকান্তিক চেষ্টাই পারে পাখি শিকার বন্ধ করতে।তাই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে,পাখি শিকারীদের প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে।পাখি শিকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।  তাহলেই হয়তো আর কোন প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হবে না এবং তারা প্রকৃতির শোভাবর্ধন করবে।

সুকান্ত দাস
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


আরও পড়ুন