হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুর : ট্যানারি শ্রমিকদের জন্য পরিবর্তন যৎসামান্য 

news paper

সাদিক হাসান পলাশ

প্রকাশিত: ২২-১১-২০২২ দুপুর ৪:১

30Views

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) মতে, বাংলাদেশে ২৫০টিরও বেশি ট্যানারি রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৯০টিকে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ধরা যায়। তৈরি পোশাক শিল্পের পরে চামড়া শিল্পকে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য বলে গণ্য করা হয় (যদিও অন্য এক প্রতিবেদন অনুসারে এটি ৩য়- পাট ও পাটজাত পণ্যের পরে)। বর্তমানে দেশীয় চামড়ার বাজারের আকার প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাপী চামড়া ও পণ্যের বাজার হলো ২৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মাত্র ৩ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে ।

২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯৪১.৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ অর্থবছরে ৭৯৭.৬ মিলিয়ন ডলার, ২০১৯ অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮ অর্থবছরে ১.১ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭ অর্থবছরে ১.২ বিলিয়ন ডলার।

চামড়া রপ্তানির এই পতন শিল্পমালিক, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন অংশীদার,অন্যান্য অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সঙ্গত কারণে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। রপ্তানিমুখী এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায়গুলি খুঁজে বের করা  খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চামড়া শিল্পকে প্রভাবিত করে এমন একটি বড় কারণ অনেকেই চিহ্নিত করেছে- তা হল পরিবেশগত এবং শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার।

বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে শ্রমিকের বেতন-সুবিধা ও  কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প খুবই খারাপ অবস্থানে আছে- যা বাংলাদেশের অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাতে পরিচালিত অন্য কিছু শ্রম-ঘন শিল্পের চেয়েও নিম্নতর। বাংলাদেশ সরকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলিকে সাভারের একটি নতুন উন্নত ট্যানারি এস্টেটে স্থানান্তরিত করেছে। কিন্তু এই স্থানান্তরের পরে, শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ও কাজের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি; চামড়া শিল্প এখনও ন্যূনতম মজুরি ও মৌলিক শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে এবং শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে সংগ্রাম করছে।

চামড়া শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, রপ্তানির পরিমাণ এবং মূল্যের সাম্প্রতিক পতন এবং উন্নত, স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ জীবনের জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের দাবি সত্ত্বেও,  লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি কম। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ এবং অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান খাতে যেই সব সুবিধা দেওয়া হয় (যেমন ওভারটাইম, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কাজের ঘন্টা, ইত্যাদি), এইসব বিষয়ে ট্যানারিগুলো পিছিস আছে। ট্যানারি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে অনেক গবেষণা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো- ২০১৯ সালে সাভারের হেমায়েতপুরের লেদার এস্টেটের ১০টি ট্যানারিতে ২২৩ জন শ্রমিকের মধ্যে  একটি গবেষণা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সমীক্ষায় ৫২ শতাংশ শ্রমিকদের চর্মরোগ, ৩৩ শতাংশের পেশীর ব্যাধি, ২৩ শতাংশের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, ১৫ শতাংশের দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা এবং ১৫শতাংশের শ্বাসকষ্টের সমস্যা পাওয়া গেছে।

এতে আরো লক্ষ্য করা যায় যে, সমস্ত ট্যানারি ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময়; ৮টিতে অপর্যাপ্ত আলো এবং উদ্বেগজনক তাপমাত্রা, ৬টিতে অসহনীয় শব্দ এবং ৫টিতে বায়ুচলাচল ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল। মাত্র ৩টির পাসযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা ছিল। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) মোটেও ব্যবহার করছিলেন না এবং তাদের কর্মীদের জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কোনও ট্যানারিতে কোনও চিকিৎসা সুবিধা ছিল না। আরেকটি বাংলাদেশী গবেষণায় ১০টি ট্যানারির ১৬৭ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার
নেওয়া হয়। এসময় তাদের পেশাগত কর্মক্ষেত্র ও স্বাস্থ্যের ফলাফল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কর্মীদের মেয়াদের পাশাপাশি তাদের কাজের ক্ষেত্রগুলির ডেটা (বিম হাউস, ওয়েট ফিনিশিং, ড্রাই ফিনিশিং ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এতে বলা হয়, শ্রমিকদের সকলেই কাজের সময় শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিলেন এবং ওয়েট ফিনিশিং ও ড্রাই ফিনিশিং-এ কর্মীদের শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা খুবই বেশি। এছাড়াও বিম হাউসে কাজ করলে চর্মরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। 

ভারতের উত্তর প্রদেশের ২৮৪টি ট্যানারি এবং ২৮৯ নন-ট্যানারি শ্রমিকদের উপর একটি সমীক্ষাতে দেখা যায় যে, ট্যানারি কর্মীদেড় মধ্যে ফিসার, হাত বা আঙ্গুল চুলকানি, হাত বা আঙ্গুলে ফাটল, হাত বা আঙ্গুলের মধ্যে ভেসিকল এবং হাত বা আঙ্গুলে লাল ও ফোলা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেসব কর্মীদের ত্বকে মাঝারি থেকে উচ্চতর রাসায়নিকের সংস্পর্শ ছিল, তাদের হাত বা আঙ্গুলের স্কেলিং এবং ফিসার সহ হাত বা আঙ্গুলে চুলকানি হওয়ার সম্ভাবনা ৩১ গুণ বেশি বেড়ে যায়। এছাড়াও ওয়েট ফিনিশিংয়ে নিয়োজিত ট্যানারি শ্রমিকদের হাত বা আঙ্গুলে ফাটল ধরার সম্ভাবনা ৪ গুণ বেশি।

ইন্দোনেশিয়ার ট্যানারির গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে শ্রমিকদের ত্বকের রাসায়নিকের সংস্পর্শ নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ৪৭২ জন শ্রমিকের ১২ শতাংশই চর্মরোগে আক্রান্ত এবং ৯ শতাংশ ওএসডি-এর ইতিহাস রিপোর্ট করেছে। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শতাংশে একজন চর্মরোগী বিশেষজ্ঞ দ্বারা চিহ্নিত হয়েছেন এবং ৭.৪ শতাংশের পেশাগত কারণে চর্মরোগ হয়েছিল।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, চর্মরোগ থেকে সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার প্রাথমিকভাবে নিশ্চত করা হয়নি। আরেকটি গবেষণায় পাকিস্তানের করাচির কোরাঙ্গি শিল্প এলাকায় ৯৫টি ট্যানারিতে নিযুক্ত ৬৪১ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এতে দেখা যায় যে, প্রাপ্তবয়স্কদের হাঁপানি এবং কাজ-সম্পর্কিত হাঁপানির প্রাদুর্ভাব যথাক্রমে ১১ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ট্যানারির কর্মী যদি অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন না হয়, ধূমপায়ী হয় এবং কাজের সময় গ্লাভস ব্যবহার না করে- তখন তাদের হাঁপানির সম্ভাবনা যায়। এছাড়াও, এই গবেষণাটি একই সাথে অনুভূত অ্যালার্জি এবং কাজের মেয়াদের মধ্যে একটি সম্পৰ্ক দেখিয়েছে। যাদের অ্যালার্জি আছে বলে মনে করা হয়, তারা ৮ বছর কিংবা তার অধিক সময় ট্যানারির কাজে থাকলে তাদের অ্যাজমা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

গবেষণা অনুসারে, পাকিস্তানের ট্যানারি কর্মীদের মধ্যে চুল এবং পায়ের নখের ক্রোমিয়ামের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। সংক্ষিপ্ত এই পর্যালোচনায় ট্যানারিতে যেসব দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা হতাহত হয় তা  অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দেশে-বিদেশের এই গবেষণার সারাংশ  থেকে বোঝা যায় যে সাভারের নতুন ট্যানারি এস্টেটেও ট্যানারি শ্রমিকরা এসব ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছেন এবং তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বরং হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের পরে তাদের বাসস্থান, পরিবহন, চিকিৎসা সুবিধা এবং বাচ্চাদের জন্য স্কুল খোঁজার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

এই শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে কোনো উন্নতি হয়েছে এখন পর্যন্ত  কোন প্রতিবেদন তা উল্লেখ করা নেই। তাই হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে নতুন কর্মজীবন শুরু করার পরেও বাংলাদেশের ট্যানারি শ্রমিকদের জীবন-মানের পরিবর্তন হয়েছে যৎসামান্য।

লেখক:

ড. হাসনাত এম আলমগীর

অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য বিভাগ,
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার
অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)।

(ইংরেজি থেকে অনুদিত)


আরও পড়ুন