এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’ প্রদান

news paper

আব্দুর রব সুজন

প্রকাশিত: ১৩-১১-২০২২ দুপুর ১১:৪৬

9Views

বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য এ বছর ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’ পেলেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এ পুরস্কার পেলেন মৌরি মরিয়ম।শনিবার সন্ধায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’ প্রবীন নবীন- দুু’জন কথাসাহিত্যিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

সহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়স্ক লেখক) ‘ফানুস’ উপন্যাসের জন্য মৌরি মরিয়ম এ পুরস্কার পান।‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’ এর জন্য গঠিত বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি, খ্যাতিমান কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা এখনও সোচ্চার ও সক্রিয়। পাকিস্তান যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ করেছিল, তেমনি দেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়, মানুষকে শোষণ করতে চায়।তিনি আরো বলেন, হুমায়ূন আহমেদের কদর দিন যত যাবে ততই বাড়বে। এ অমর কথাশিল্পী সবসময়ই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৫ এর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজাকার বা হানাদার বাহিনী শব্দ লেখা নিষিদ্ধ ছিল। সেই পরিস্থিতিতেও হুমায়ূন আহমেদ ‘তুই রাজাকার’ শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন, লিখেছিলেন।

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, যাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে, পরের চার দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় আচ্ছন্ন রেখেছেন কোটি বাঙালিকে। পরিস্থিতি নির্মাণ, বর্ণনাভঙ্গি, সংলাপে তিনি এমন শৈলীর উদ্ভাবন করেছেন যা বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।আপন দ্যুতিতে উদ্ভাসিত প্রয়াত এই লেখকের স্মরণে এবং দেশের নবীন-প্রবীণ কথাশিল্পীদের শিল্পসৃষ্টিতে প্রেরনা জোগাতে ২০১৫ সালে প্রবর্তিত হয় ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। এক্সিম ব্যাংকের সহযোগিতায় পাক্ষিক ‘অন্যদিন’-এর এই উদ্যোগ। এ বছর অষ্টমবারের মতো এ পুরস্কার প্রদান করা হলো। 

কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য প্রবীণ কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়স্ক লেখক) মৌরি মরিয়ম। তাঁরা পুরস্কার হিসেবে পেলেন যথাক্রমে পাঁচ লাখ এবং এক লাখ টাকা। এছাড়া তাদের প্রদান করা হয়েছে কোস্ট, উত্তরীয় এবং সার্টিফিকেট।

২০১৫ সালে সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য শওকত আলী ও নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম। ২০১৬ সালে পুরষ্কৃত হয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক ও স্বকৃত নোমান। ২০১৭ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও মোজাফ্ফর হোসেন। ২০১৮ সালে পুরস্কৃত হয়েছিলেন রিজিয়া রহমান ও ফাতিমা রুমি। ২০১৯ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন রাবেয়া খাতুন ও সাদাত হোসাইন। ২০২০ সালে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছিল হাসনাত আবদুল হাই ও নাহিদা নাহিদের হাতে। ২০২১ সালে পুরস্কৃত হয়েছিলেন সেলিনা হোসেন ও ফাতেমা আবেদীন।

আনোয়ারা সৈয়দ হক: ছয় দশক ধরে লিখছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। তাঁর লেখায় বারবার উঠে আসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু আর মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। এছাড়াও নারী জীবনের টানাপোড়েন, নারীর বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত জীবনযাপনের কথা তাঁর সাহিত্যে প্রধান একটি উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলিও তিনি তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। তাঁর জন্য ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর, যশোর জেলার মোহনগঞ্জের চুড়িপটিতে। মা প্রয়াত আছিয়া খাতুন চৌধুরী। বাবা প্রয়াত গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী। স্বামী সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক। ১৯৬৫ সালে আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। লন্ডন থেকে মনোবিজ্ঞানো এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মেডিকেল কোরে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি কাজ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে। বর্তমানে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালে মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।

১৯৫৪ সালে আনোয়ারা সৈয়দ হকের লেখালেখির সূচনা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ছানার নানাবাড়ি’ (১৯৭৬)। প্রথম উপন্যাস ‘তৃষিতা’ (১৯৮২। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: উপন্যাস- সোনার হরিণ, বাড়ি ও বনিতা, ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে, কার্নিশে ঝুলন্ত গোলাপ, সেই প্রেম সেই সময়, দুই রমণী, উদয় মিনাকে চায়, ফিরে যাবার পথ অনিশ্চিত, নিঃশব্দতার ভাংচুর, আমার রেণু, হে সন্তপ সময়। গল্পগ্রন্থ- আয়নার বন্দি, গলে যাচ্ছে ঝুলন্ত পদক, অন্ধকারে যে দরজা, পূণিমায় নখের আঁচড়, শূন্যতার সাথে নৃত্য, চাঁদের আলোর কদ্দূর, নিশিগন্ধা, হনন। কাব্যগ্রন্থ- মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি, কিছু কি পুড়ে যাচ্ছে কোথাও, কাল খুব কষ্টে ছিলাম, আমার শয্যায় এক বালিশ-সতীন, তুমি এক অলৌকিক বাড়িওয়ালা, লোকে বলে এত রাতে রাস্তায় হেঁটে যায় কে। শিশুতোষ গ্রন্থ- ছানার নানাবাড়ি, ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ, হানাদার বাহিনী জব্দ, হায়নাদের হয়রানি, আগুনের চমক, ভয়ংকর সেই রাত,  রাসেল তার আব্বুর হাত ধরে হেঁটে যায়। প্রবন্ধ গ্রন্থ- নারীর কিছু কথা আছে, নারীর কোনো কথা নাই, কিশোর- কিশোরীর মন ও তার সমস্যা, পিকাসোর নারীরা, যোগাযোগের মধুসূদন ও অন্যান্য প্রবন্ধ। স্মৃতিকথা: নরক ও ফুলের কাহিনী, অবরুদ্ধ, বিক্ষুব্ধ সংলাপ।

বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আনোয়ারা সৈয়দ হক বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১০) এবং দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক (২০১৯)। এবার কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার–২০২২’ অর্জন করলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক।

মৌরি মরিয়ম: তরুণদের মধ্যে পরিচিত লেখক মৌরি মরিয়ম নবীন শাখায় পুরস্কারটি পাচ্ছেন তাঁর‘ফানুস’ উপন্যাসের জন্য। তাঁর লেখায় মানবিক সম্পর্ক, প্রেম, মান-অভিমান, ভ্রমণ, যাপিত জীবন সমকালের প্রেক্ষাপটে এসব বিষয় মূর্ত হয়ে ওঠে। লেখালেখির সূচনা গল্প-উপন্যাস পড়ার সূত্রে। ‘প্রেমাতাল’, ‘অভিমানিনী’ তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস। বরিশালের গৌরনদীতে জন্ম, মৌরি মরিয়মের ছোটবেলা কেটেছে ঢাকার ধানমন্ডির রায়ের বাজারে। বেড়ে উঠেছেন এই এলাকাতেই। পড়েছেন ধানমন্ডি গার্লস স্কুল, বদরুন্নেসা কলেজ এবং স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সাংবাদিকতায় স্নাতক। এটি তাঁর প্রথম পুরস্কার।

বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন এক্সিম ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মো. আব্দুল বারী এবং বিশিষ্ট সংগীত নির্মাতা হুমায়ুন-পত্নী মেহের আফরোজ শাওন। শংসাবচন পাঠ করেন বিচারকমন্ডলীর সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ আজিজুল হক ও স্বনামধন্য কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী। অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্যের মাধ্যমে।


আরও পড়ুন