তৈরী পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা

news paper

হাসনাত এম আলমগীর

প্রকাশিত: ২০-৯-২০২২ বিকাল ৫:৭

27Views

যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের সহযোগিতার জন্য এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের জন্য এই মাধ্যমটি নিয়ে লিখেছেন হাসনাত এম আলমগীর 

গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম সৈনিক। তবে তারা নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আশার কথা হলো- অনিরাপদ কাজের পরিবেশ, স্বল্প মজুরি ও সুবিধা এবং কারখানায় অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে গত কয়েক বছরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তারা কিছুটা মনোযোগ পেয়েছে। কর্মীদের ক্ষমতায়ন উদ্যোগ- তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা উন্নত করে। যা সারা বিশ্বের অনেক আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্প গবেষণায় প্রমাণিত। কার্যকর যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটির মাধ্যমে কর্মীদের ক্ষমতায়ন করা এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার তথ্য প্রতিবেদনের ব্যবস্থা থাকা হল পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার উন্নতির দুটি মূল এবং প্রমাণিত উপায়। সফল কর্মী ক্ষমতায়ন কর্মসূচির মধ্যে প্রায়ই কার্যকরী কর্মক্ষেত্র কমিটি গঠন অন্তর্ভুক্ত থাকে। কমিটির সদস্যদের জন্য নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ কর্মীদের জন্য সচেতনতা প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শ্রমিকদের তাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা এবং সমস্যাগুলির বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্য একটি ব্যবস্থা হলো এটি।

যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কর্মী ও নিয়োগকর্তাদেরকে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং সমাধানের জন্য সহযোগিতা করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দেয় এই কমিটি। এটি বাংলাদেশের কাজের অবস্থার উন্নতি এবং শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও অসুস্থতা থেকে রক্ষা করার একটি ভালো উপায় হতে পারে। এই কমিটি কর্মী এবং নিয়োগকর্তার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। কমিটির সদস্যরা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সমস্যা চিহ্নিত, শ্রেণীবিভাগ এবং সমাধানের জন্য একসাথে কাজ করে। এই কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য হল পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ সহজতর করা।

একটি কার্যকর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি কর্মক্ষেত্রে আঘাত এবং অসুস্থতার সাথে সম্পর্কিত ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে। ‘যোগাযোগ’ কর্মক্ষেত্রে একটি কার্যকর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার চাবিকাঠি। এই কমিটি শ্রমিক ও  মালিক পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। এটি বিপত্তি শনাক্ত ও তার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি বৈচিত্র্যময় এবং বিস্তৃত পরিসরের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকেও একত্রিত করে। কমিটির কাজ হলো- কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে কার্যকর সমাধান বের করা। এতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, আঘাত এবং অসুস্থতা হ্রাস পায়, যা উৎপাদন বাড়ায় এবং কর্মক্ষেত্রে দলবদ্ধভাবে কাজ করার সংস্কৃতি বিকাশে অবদান রাখে।

কানাডায়, যদি কোন কর্মক্ষেত্রে ২০ বা তার বেশি কর্মী থাকে, তবে সেখানে যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। কর্মক্ষেত্রে যদি ৯ থেকে ২০ জনের কম কর্মী থাকে, তবে এটির একজন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। কমিটির সদস্যদের অন্তত অর্ধেক অবশ্যই এমন কর্মী হতে হবে যাদের কোন ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব নেই এবং তারা নিজেদের বা তাদের ইউনিয়ন দ্বারা নির্বাচিত।

বাংলাদেশের শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৩ কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার উন্নতির জন্য বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬-এ বেশ কয়েকটি সংশোধন করে। এর জন্য এখন ৫০ এর বেশি শ্রমিকের কারখানায় সুরক্ষা কমিটি গঠন, শ্রমিক সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি, এমন কারখানায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং ৫০০ জনের বেশি শ্রমিকের কারখানায় সুরক্ষা কল্যাণ কর্মকর্তার প্রয়োজন। সরকারের শ্রম পরিদর্শককে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিদর্শনের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীগুলো বিবেচনায় রাখা হয়- শিশুদের জন্য বিপজ্জনক কাজ, জরুরী প্রস্থান, শ্রমিকদের সিঁড়ি ব্যবহার নিশ্চিত, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের বাধ্যতামূলক ব্যবহার, কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি সম্পর্কিত। এই সমস্ত ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। যা যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি নিয়মিত তদারকি করে।

যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি কর্মক্ষেত্রের বিপদ চিহ্নিত ও নির্মূল করতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে নিম্নলিখিত কাজ করে:

  • কর্মীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর বা অনিরাপদ পরিস্থিতি চিহ্নিত এবং কার্যকর পরামর্শ প্রদান
  • স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ
  • পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে কর্মী ও নিয়োগকর্তার সাথে আলোচনা
  • কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষামূলক কর্মসূচির বিষয়ে নিয়োগকর্তাকে সুপারিশ প্রদান
  • বাংলাদেশ শ্রম আইনের অধীনে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম এবং নীতি সম্পর্কে নিয়োগকর্তাকে পরামর্শ প্রদান এবং পর্যবেক্ষণ
  • শ্রমিকদের নিরাপত্তা জন্য নিয়োগকর্তাকে প্রয়োজনে সরঞ্জাম সরবরাহ এবং যন্ত্রপাতির পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ প্রদান
  • দুর্ঘটনা এবং বিপজ্জনক ঘটনার তদন্ত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত পরিদর্শন নিশ্চিত করা
  • স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মসূচী, নীতি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা  ও প্রচার করা
  • শ্রমিকের কাজ করতে অস্বীকার করার বিষয়ে তদন্ত করা

কর্মক্ষেত্রে একটি কার্যকর যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি থাকলে:

  • দুর্ঘটনা কমে যায়
  • যৌথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়
  • সমস্যা সমাধানের জন্য বিস্তৃত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগে
  • নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়
  • কর্মীরা মতাতমত প্রকাশ করা ও সমস্যা সমাধান করার উপায় খুঁজে পায়

পশ্চিমা ক্রেতা, বাংলাদেশ সরকার, দাতা দেশ এবং সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও, শ্রমিকদের অধিকারের সমর্থক এবং ভোক্তা গোষ্ঠীগুলোকে অবশ্যই পোশাক শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আরো উন্নত করতে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে। কর্মী ক্ষমতায়নের  এই উদ্যোগে কর্মীদের সন্তুষ্টি বাড়াবে, তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে, কর্মীদের অনুপস্থিতি হ্রাস করবে এবং কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে। ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত বিশ্ব বাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরী করতে সমর্থ হবে।

লেখক: অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য বিভাগ, 
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)


(ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাদিক হাসান পলাশ)

 


আরও পড়ুন