সৈয়দ আবুল হোসেনের সততা এবং পদ্মা সেতু

news paper

শামীম আহমদ

প্রকাশিত: ১-৬-২০২২ রাত ৯:২৭

26Views

ব্যক্তিজীবনে যে যতো বিনয়ী ও নম্র, সে তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। বিনয়গুণ দিয়ে অন্যের চোখে বপন করা যায় ভালোবাসার বীজ। আর যারা আল্লাহর হুকুম পালন করে তারা শ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র এবং তাদের বন্ধু আল্লাহ। বিনয় শব্দের অর্থ নম্রভাব, নম্রতা, কোমলতা, মিনতি প্রভৃতি। নম্রতা শব্দের অর্থ বিনীত, ঔদ্ধত্যহীন, নিরহংকার, অবনত, নরম, কোমল, শান্তশিষ্ট প্রভৃতি। বিনয় ও নম্রতার মূল হলো, তুমি তোমার দুনিয়ার নিয়ামতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নিচের স্তরের লোকদের সঙ্গে রাখো, যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবী নিয়ামত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির কাছে, যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে দুনিয়া নিয়ে সে তোমার ওপর মর্যাদাবান নয়।
 
পদ্মা সেতু নিয়ে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের পরেও আবুল হোসেন তার ভদ্রতা প্রকাশ করছেন। আমরা জানি ব্যক্তিজীবনে যে যতো বিনয়ী ও নম্র, সে তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। যারা আল্লাহর হুকুম পালন করে তারা শ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র এবং তাদের বন্ধু আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রসুল (স.) ও মুমিনগণ যারা বিনত হয়ে চলে। বিনয় ও নম্রতা ইসলামি আদর্শের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের বর্ণনা ইসলাম সুনিশ্চিতভাবে সুচারুরূপে ব্যক্ত করেছে। উজ্জীবিত করেছে সমূহ কল্যাণকর দিকে। বারণ করেছে যাবতীয় অমঙ্গল থেকে। ইসলাম মানুষের কল্যাণার্থে যেসব সচ্চরিত্রের সন্ধান দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বিনয় ও নম্রতা নেহায়েত উল্লেখযোগ্য। বিনয় ও নম্রতা মানুষের মহৎ গুণ। যা মানুষকে অপরাপর সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। পৃথিবীর সকল মহামানবের মধ্যেই এ গুণটি বিরাজমান। আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন নিতান্ত বিনয়ী। তাঁর বিনয় ও নম্রতার দিগদিগন্ত সর্বোৎকৃষ্ট, অনুপম। আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ, মুক্তির সোপান। ভালো কথা ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে শত্রুর মন জয় করা সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। অতএব মন্দকে উত্তম (ব্যবহার) দ্বারা প্রতিহত কর। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে, (অচিরেই) সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে’ (আল-কুরআন, সুরা হা-মীম সাজদাহ, ৩৪)। মহান রাব্বুল ইযযাত আরও ইরশাদ করেন, ‘তারাই তো আল্লাহর প্রকৃত বান্দা যারা জমিনে নম্রতার সঙ্গে চলাফেরা করে’ (আল-কুরআন, সুরা ফুরকান-৬৩)।
 
যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাবস্থায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সূচনা কালে কিছু সংবাদ মাধ্যমে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। সেই বিরোধীদের প্রতি আবুল হোসেনের আচার-আচরণে নম্রতা অবলম্বনের বিষয়টি লক্ষ করছি। মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলকে বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে। যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো। সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৫৯, এ ছাড়াও সুরা শুআরা, আয়াত : ২১৫ আল্লাহ বলছেন- ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও। মহান আল্লাহ বিনয়ী মানুষদের প্রশংসায় বলেন, “দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’।” সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬৩-৬৬, অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এটা আখিরাতের নিবাস, যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাকিদের জন্য আছে শুভ পরিণাম।’ সুরা কাসাস, আয়াত : ৮৩, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনের যে গুণে সবাই ভালোবাসে সেসব গুনের মধ্যে সততা ও বিনম্রতা একটি। বিনয় মানুষের এক মহা গুণ। বিনয়ী আল্লাহর প্রিয়। মানুষসহ অন্য মাখলুকেরও প্রিয়। বিনয়ীর সঙ্গেই সবাই ওঠা-বসা করতে চায়। অহংকারীর সঙ্গে কেউ চলতে চায় না। তাকে কেউ ভালোবাসে না। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি বিনম্র থেকেছেন। আপনি যদি কর্কশ ও কঠোর মনের হতেন তাহলে এরা সবাই আপনার চারপাশ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ত। সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯
 
বিনয়ী সবার চোখে বড় : মাটির মানুষকে সব সময় থাকতে হবে মাটির মতো বিনয়ী। বিনয় হলো মাথার মুকুট। যা শোভা-সৌন্দর্য বাড়িয়ে অন্যদের চোখে তাকে করে তোলে শ্রদ্ধাশীল ও মর্যাদাবান। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর জন্য যে বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে সমুন্নত করেন। তখন সে নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হয়। মন্ত্রী পদ থেকে আবুল হোসেন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন। যদিও তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আনা হয়েছিল। একটি মহল জুলুম করছে সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি। কিন্তু আবুল হোসেন সততা দৃঢ়তায় শক্ত অবস্থান নেন নি। বিনয়ী বিনয়ের কারণে দলিত হলে ও জুলুমের স্বীকার হলে শক্ত হওয়ার অনুমতি আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ আমার কাছে এ মর্মে অহি পাঠিয়েছেন যে তোমরা বিনয়ী হও- যতক্ষণ না একে অপরের ওপর জুলুম করে এবং অহংকার করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যে মন্ত্রী পরিষদ গঠন হয়ে ছিলো সেই মন্ত্রী পরিষদের একজন সৎ সদস্য ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। সততার জন্য তিনি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় মহান উদার, বিনয়ী ও নম্র ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। সৈয়দ আবুল হোসেন  একাধারে সমাজসংস্কারক, ন্যায়বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল মন্ত্রী। জনগণের কল্যাণে তিনি হাত দিয়েছিলেন পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে। কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই মাদারীপুর তথা দেশবাসীর নিকট আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছেন।
 
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে মানুষের হৃদয়ে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাঁর স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছিল সদা জাগ্রত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আচার-আচরণে অত্যন্ত বিনয়ী। কখনো দুর্বল ব্যক্তিকে কটু কথার মাধ্যমে হেয়প্রতিপন্ন করতেন না। এমনকি কোনো মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে অসাধ্য কাজে বা কঠিন দায়িত্বে বাধ্য করতেন না। দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে সময় নিয়ে আলাপ করে তাদের দুঃখ দুর্দশা দুর করতে ভুমিকা রাখছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। সমাজে যে যতটুকু মর্যাদার অধিকারী, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও আশাতীত সুন্দর কোমল আচরণ লাভ করত। তিনি এতই নমনীয় ও কোমলতর ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন, যে কারণেও অনুসারীরা তাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসত এবং মনে-প্রাণে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। মন্দের প্রতিবাদ তিনি মন্দ দিয়ে করতেন না, বরং মন্দের বিনিময়ে তিনি উত্তম আচরণ করতেন। সব বিষয়েই। তিনি ক্ষমাকে প্রাধান্য দেন। তিনি এতটা বিনয়ী ও নম্র যে, কথা বলার সময় কারও মুখমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে কথা বলতেন না। কোনো অশোভন বিষয় উল্লেখ করতেন না। তিনি সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন ও সদালাপ করেন। তাঁর মধুর বচনে সবাই অভিভূত হয়।
 
সৈয়দ আবুল হোসেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। এককথায় অন্য সকল রাজনৈতিক নেতার মধ্যে একজন আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা। তার সৎ স্বভাব, সত্যনিষ্ঠা, সৌজন্যবোধ, বিনয় ও নম্রতা মানুষকে যে অনুপম শিক্ষা দেয়, তা আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তাঁর সাধারণ জীবনযাপন, বিনম্র আচার-আচরণ, উপদেশাবলি অনুসরণ করলে নিজেদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্র সহজ হবে। সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিশোধ নেয়ার লোক নয়। কারো ওপর প্রতিশোধ নেয়া বা কাউকে ঘায়েল বা পরাভূত করতে পারাটাই বীর হওয়ার লক্ষণ নয়, বীর হলো ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে ক্রোধের সময় সংবরণ করতে পারে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর সেই বান্দাদের প্রশংসা করেছেন, যারা রাগের সময় প্রতিশোধ না নিয়ে মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। এটা খাঁটি মুমিনদের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। তারা ক্রোধের সময় নিজেদের হারিয়ে ফেলে না; বরং তখনো ক্ষমা ও অনুকম্পা তাদের মধ্যে প্রবল থাকে। ফলে ক্ষমা করে দেয়। তারা রূঢ় স্বভাবের হয় না; বরং নম্র স্বভাব ও ধীর মেজাজের মানুষ হয়। তাদের স্বভাব প্রতিশোধপরায়ণ হয় না। তারা আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে ক্ষমার আচরণ করে এবং কোনো কারণে ক্রোধান্বিত হলেও তা হজম করে। এটি মানুষের সর্বোত্তম গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনেও এই গুণগুলোকে অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। এবং মহান আল্লাহ এই মহৎ গুণের অধিকারীদের তাঁর প্রিয় বান্দা বলে ঘোষণা করেছেন।
 
বিনয় মানুষের ভদ্রতার পরিচায়ক। একজন ব্যক্তি অভিজাত কিনা সেটা তার বিনয় দেখেই বুঝা যায়। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সে হিসাবে তাকে যে সমস্ত মানবিক গুণাবলী দেয়া হয়েছে, বিনয় তার মধ্যে অন্যতম। বিনয়ের বিপরীত শব্দ অহংকার। বিনয় বাদ দিলে একজন মানুষ হয় অহংকারী। অহংকারী ব্যক্তির আচরণ আক্রমনাত্মক। মানুষের অফেন্স হলো অহংকার আর বিনয় হচ্ছে ডিফেন্স। আক্রমনাত্মক ব্যক্তি সব সময় অশান্তির খোঁজ করে পক্ষান্তরে রক্ষণাত্মক ব্যক্তি শান্তির অনুকূল। মানুষ বিনয়ী হবে এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রাকৃতিক সত্য। এজন্য তাকে কৃতিত্ব দেয়ার কিছু নেই। পশু বিনয়ী হলে অবশ্য অবাক হওয়ার বিষয়। বিনয় হচ্ছে মানুষের একটা আচরণগত বিষয়। যে যত সভ্য, বিবেকবান তার আচরণ হবে ততটাই বিনয়ী । বিনয় মানুষকে সামাজিক করে, জনপ্রিয় করে এবং মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ধরে রাখে। এটা মানুষের  শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। পশুদের বিবেক দেয়া হয়নি বলে তাদের বিনয়ী হতে হয় না। ভদ্র কথাটার বিপরীত শব্দ হলো ইতর। কাজেই মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হয় বিনয় দিয়ে, ভদ্রতা দিয়ে। যে মানুষ বিনয়ী সে মানুষ হবে সকল মানুষ। এমন কি সকল জীব জন্তুর জন্য একজন নিরাপদ মানুষ। যে মানুষ নিরাপদ তাঁর দ্বারা কোন মানুষ বা অন্য কোন জীবের ক্ষতি সাধিত হতে পারে না। ইদানিং দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে পেশী শক্তির প্রাদূর্ভাব যত বাড়ছে, বিনয়ের কদর তত কমছে। এখন আর কেউ বিনয়ী হতে উৎসাহ পায় না। মানুষ এখন বিনয় প্রকাশ করতে ভয় পায়। কারণ এখন বিনয়কে দেখা হয় দুর্বলতা হিসাবে। বিনয়ী ব্যক্তিকে নিরীহ বলে, ভদ্রলোক বলে কটাক্ষ করা হয়। এখন বেঁচে থাকার তাগিদে পেশীহীন ব্যক্তিও পেশী ফুলানোর ভান করে। বিনয়ের বদলে সমাজটা এখন হুংকারের দিকে ঝুকে যাচ্ছে।
 
এ সবই হচ্ছে আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে। অবক্ষয় হচ্ছে নিচে নেমে যাওয়া। আমরা মানুষ ছিলাম এখন আমরা নিচে নেমে যাচ্ছি। সেই নিচেটা কোথায়? উত্তর পানির মত সোজা। আমাদের বর্তমান গন্তব্য সোজা পশুত্বের দিকে। যেখানে বিনয়ের বদলে পাশবিকতার চর্চা হয় দিনরাত। মানুষ যদি তার মানবিক বৈশিষ্ট্য হারায় তবে তার পশু হতে বাকি  কোথায়? তবে পশু কথাটা শুনতে একটু খারাপ লাগে- এই যা। আমি মানুষ কিন্তু আমার আচরণ পাশবিক- এটা কোন ক্রমেই মানান সই নয়। হয় আমাকে পুরোপুরি মানুষ হতে হবে, নয়তো মানুষ পরিচয় ছাড়তে হবে। মানুষ-পশুর মাঝামাঝি কোন গ্রহণযোগ্য স্তর থাকতে পারে না। রূপকথায় মৎস্য কন্যার উল্লেখ আছে। মৎস্য কন্যাদের অর্ধেক দেহ মানুষের বাকী অর্ধেক মাছের। মানব পশু বা পশু মানব হওয়ার বাস্তব কোন সুযোগ নেই। পশুত্বে আর মনুষত্বে মাখামাখি করে মানুষের কোন গ্রহণযোগ্য পরিচয় দাঁড় করানো যাবে না। কারণ পাশবিকতা আর মানবিকতা দুটোই বিপরীত মুখী প্রবণতা। তাদের গন্তব্য আলাদা। তবে এদের একটা আলাদা পরিচয় অবশ্য আমরা জানি, আর সেটা হলো নরপশু। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা বিরোধীতা করছে। বলছে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। এখন নির্মাণ হয়ে গেছে। সেই বিরোধীরা এখন বলছে পদ্মা সেতু আদৌও দরকার নেই। এই হলো ষড়যন্ত্রকারিদের বৈশিষ্ট্য। কথা হচ্ছিল বিনয় নিয়ে। এক কথায় বিনয় হচ্ছে মানুষ আর পশুর মাঝে পার্থক্যের নির্দেশক। যে যত ভদ্র, বড় আর জ্ঞানী সে তত বিনয়ী। সমাজ পরিবার ও দেশের শান্তির জন্য বিনয় চর্চার কোন বিকল্প নেই। আজকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে ঘোর অমানিশায় আমাদের চারপাশ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেখান থেকে মুক্তির পথ আমাদেরই বের করে নিতে হবে। প্রথমেই সকল স্তরে বিনয়ের অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে হবে। সমাজে বিনয়ী মানুষকে সম্মান ও উৎসাহ দিতে হবে। বিনয়কে দুর্বলতা হিসাবে দেখার প্রবণতা সকলকেই ছাড়তে হবে। মনে রাখতে হবে বিনয়ের বিপরীত হলো গর্জন তথা ধমক। কোথাও বিনয়ে কোন কাজ হচ্ছে না বলে সবাই গর্জন তথা ধমক অথবা পেশী শক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা বিনয়ের জন্য খুবই প্রতিকূল পরিবেশ। সমাজে বিনয়ের কদর না থাকলে মানুষ কেন বিনয়ী হবে? সমাজে যখন বিনয়ের কদর থাকে না, তখন সব কিছুই চলে গর্জন তথা ধমকে। যারা বিনয়ী তারা ভদ্র আর তাই তারা গর্জন বা ধমক দিতে জানেন না। আর আমরা সবাই জানি এখন ধমক ছাড়া কোন কাজই হয় না। তবে এখন ধমক ছাড়াও কাজ হচ্ছে, টাকা দিয়ে। এখন সমাজের বিনয়ী লোকদের গর্জন না জানার কারণে মাশুল দিয়ে সব কাজ করাতে হয়। মাশুল কি জন্য? সে বিনয়ী বলে। অর্থাৎ বর্তমান সমাজে বিনয়ী লোকদের শুধুমাত্র বিনয়ী হওয়ার কারনে ঘুষ দিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তা হলে মানুষ বিনয়ী হবে কি জন্যে? এটা বিনয়ী আচরণের জন্য খুবই প্রতিকূল পরিবেশ। যে সমাজে বিনয় চর্চা নেই সেই সমাজে মানুষের জন্য নিরাপত্তাও নেই।
       
মানুষ মানুষের ভাই হলে সকল মানুষেরই সকলের জন্য নিরাপদ হওয়ার কথা। নিজে আক্রমনাত্মক হওয়া দূরের কথা, কোন মানুষকে যদি অন্য কিছু আক্রমন করে, তবে তা থেকে তাকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসাই মানুষের কাজ। একজন সাচ্চা মানুষ কখনো অন্য মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারেন না। নীতিগতভাবে সকল মানুষেরই সাচ্চা মানুষ হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে সকল মানুষই আর এখন সাচ্চা মানুষ হন না। অবশ্য সকল মানুষই সাচ্চা মানুষ হলে আলাদা করে এই “সাচ্চা” শব্দটার কোন প্রয়োজন পড়তো না। আমাদের চারপাশ এখন অসাচ্চা মানুষে ভরে উঠছে। তাই এখন মানুষই হয়ে উঠেছে মানুষের নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ। নিরাপদ মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। যেখানে হিংস্র পশুরা মানুষের নিরাপত্তা হুমকীর একমাত্র কারণ হওয়ার কথা, সেখানে বর্তমানে মানুষেরাই পশুদের পিছনে ফেলে মানুষের আরো ভয়ংকর নিরাপত্তা হুমকীর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মানুষই মানুষের সবচে বড় শত্রু, সবচে বড় বিপদ। মানুষের সর্বনাশ করতে হলে এখন আর বাইরের কোন কিছুর আক্রমন দরকার নেই। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশে মহাব্যস্ত। এখন কোন প্রকার ইন্ধন ছাড়াই মানুষ মানুষের চরম সর্বনাশ করে অবলীলায়। তাই এখন নিরাপদ মানুষের বড় অভাব। আমাদের সমাজের বর্তমান নানা অশান্তির মূল কারণ নিরাপদ মানুষের অভাব। বর্তমান বিশ্বে মানুষই এখন মানুষের সবচে বড় নিরাপত্তা হুমকী। মানুষই আজ ঢাক ডংকা পিটিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? তাদের যুদ্ধ মানুষেরই বিরুদ্ধে। মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এখন এই তথাকথিত যুদ্ধ থামাতে প্রয়োজন বিশ্বের দেশে দেশে নিরাপদ মানুষের উত্থান। প্রয়োজন নিরাপদ মানুষের হাতে নেতৃত্ব। সর্বপ্রথম দরকার নিরাপদ মানুষ হওয়ার কনসেপ্ট সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। নিরাপদ মানুষ আমাদের সমাজে এখনো কিছু কিছু রয়েছেন। তাদের নিয়েই নিরাপদ মানুষ তৈরীর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানব সভ্যতার অস্তিত্ব এখন বেশী বেশী নিরাপদ মানুষের উপরই নির্ভরশীল।
 
এক সময় মানুষের নিরাপত্তার জন্য হিংস্র পশুরাই ছিল সবচে বড় হুমকী। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানুষ পশুদের হুমকীকে জয় করেছে বটে কিন্তু সভ্যতা যত বিকশিত হয়েছে মানুষ ক্রমে নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার হুমকী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশুরা নয়, আজ মানুষই মানুষের সকল আতংকের কারণ। কত বিভৎস উপায়ে মানুষকে হত্যা করা যায়, তা নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে উৎকট প্রতিযোগিতা। কে কত ভয়ংকর মারণাস্ত্র বানাতে পারে, তা নিয়ে দেশে দেশে কত বড়াই! যেন মানুষ মারার চাইতে ভালো কাজ আর হয় না! মনুষ্যত্ব থেকে মানবের এ এক বড় বিচ্যুতি। সাধারণত পশুরা বিবেকহীন হওয়ার কারণে সারাক্ষণ মারামারি কাটাকাটি করে। কিন্তু মানুষের বিবেক রয়েছে এবং তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে  মারামারি কাটাকাটি মানুষের জন্য শোভনীয় নয়। পশুর স্বভাব মানবে বেমানান। সারা বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের ডামাঢোল আর মারণাস্ত্র তৈরীর স্বগর্ব চিৎকার প্রমাণ করে, সারা বিশ্বে এখন অনিরাপদ মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। মানব সভ্যতা যে আজ চরম বিচ্যুতির মুখে, এতে এটাও প্রমাণিত হয়। মানব সভ্যতাকে এই মহা বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করতে হলে মানুষকে আবার তার আদি অবস্থান, মনুষত্বের পথে রওনা দিতে হবে। মনুষ্যত্বের প্রথম পাঠ হবে “ মানুষ মানুষের জন্যে ”। মানুষ মানুষ মারার জন্য নয়। দ্বিতীয় পাঠ হবে ’সকল মানুষ হবে সকলের কাছে নিরাপদ’। কোন মানুষের ক্ষতি না করার সংকল্প এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। অন্যের ক্ষতির চিন্তা না করাই নিরাপদ মানুষ হওয়া। মানুষের এ জন্য প্রয়োজন একটা উদার মন। নিরাপদ মানুষ হতে গেলে দৃষ্টিভঙ্গিতে উদারতা আনতে হবে। এজন্য মানুষের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। আসলে অন্যের ক্ষতি করে মানুষের জন্য কোন লাভই নেই। এটা স্রেফ একটা মানসিক দীনতা। মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। তাকে কোন প্রকার দীনতায় মানায় না। আসলে বিনয়ী আচরণের নিরাপদ মানুষ হওয়াটাই মানুষের জন্য স্বাভাবিক। মানুষ যদি তার আত্মমর্যাদাবোধের বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকে এবং সে যদি মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্যুত হতে না চায়, তবে তাকে অবশ্যই একজন বিনয়ী ও নিরাপদ মানুষ হতে হবে। নইলে শুধু শুধু তার মানুষ দাবী নিরর্থক। যে বাঙালি বাংলাদেশের উন্নয়ন চায় না, বাঙালি দাবিটাই তার নিরর্থক। সৈয়দ আবুল হোসেন পদ্মা সেতুর জন্য সততা ও উদারতার প্রতীক তা অকপটে স্বীকার করি।

আরও পড়ুন