যুগের পর যুগ অডিট হয় না : শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফান্ডের টাকা নয়-ছয়ের বিস্তর অভিযোগ

news paper

জাহিদুল ইসলাম শিশির

প্রকাশিত: ১১-৫-২০২২ দুপুর ২:৫৭

36Views

সারাদেশে স্কুল ও কলেজ ফান্ডের টাকাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ব্যাপক নয়-ছয়ের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও  নিরীক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুগের পর যুগ অডিট হয় না। কোনো প্রতিষ্ঠান অডিট হলেও বছরের পর বছর সে অডিট রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। এই সুযোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ গ্রাস করে চলেছে। সেই সাথে নিয়োগ পদোন্নোতিসহ নানা বিষয়ে অনিয়মের আখড়া হয়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর খিলগাঁও থানার ২ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনের বড় অংশ কমিউনিটি সেন্টার বানিয়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেই সাথে স্কুল ভবনের আরো কিছু দোকানও ভাড়া চলছে। স্কুলের ভবনেই চলছে স্থানীয় ক্লাবের কার্যক্রম।

কিন্তু এসব ভাড়া বা এ্যাডভ্যান্সের টাকার হদিস মিলছে না প্রায় দুই যুগ ধরে কে স্কুলের জায়গায় কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া দিল। কে তৈরী করলো আর এ্যাডভ্যান্সসহ ভাড়ার টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে। কে নিচ্ছে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না কেউ। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে স্কুলের তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। থানা জেলা বা আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস দীর্ঘ এ সময়েও জানেনা যে, স্কুলের ভবনের অংশে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার। যার নাম ফ্রেন্ডস কমিউনিটি সেন্টার। একই সাথে এ স্কুলের নিয়োগ পর্বেও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। দুজন মহিলা শিক্ষকের সনদে সমস্যা থাকার পরও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাদের চাকুরি দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে সত্য জানতে একটি গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তথ্য অধিকারে আবেদন করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে ২০১৯ সালের ৮ মে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু  উক্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি প্রক্রিয়াধীন থাকায় তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ৭(ঠ) অনুযায়ী চাহিত তথ্য দেয়া যাচ্ছে না। প্রফেসর অলিউল্লাহ আজমতগির স্বাক্ষরিত ৩৭.১৯.০০০০.০০.২২.১.১৭.৬৪২নং স্মারকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আবেদনে ২০০০ থেকে ২০২১ সাল নাগাদ স্কুলের আয় ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হয়েছিলো। ২০১৯ সালে নিরীক্ষা করার পরও কেন এতদিনে সে নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন করা গেল না সে বিষয়ে কোনো ব্যাখা ডিআইএ থেকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা পরিচালনা কমিটির সভাপতির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এদিকে দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি, ও অনিয়মের আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী আহম্মেদ বাওয়ানী স্কুল ও কলেজটি। প্রধান শিক্ষকের নানা দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি আর নিয়ম ভঙ্গে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।

শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এখন বাইরের ভাড়াটিয়াদের আড্ডা ও নানামুখি বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে প্রধান শিক্ষকের অর্থ আয়ের  বিশাল এক হাব হয়ে উঠেছে স্কুল ক্যাম্পাস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজের ইচ্ছেমতো তিনি চালাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান স্থানীয় সংসদ হাজী সেলিমের ছেলে সোলাইমান সেলিম। অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন মুন্সি মুকুল নিজেকে পরিচয় দেন সংসদ হাজি সেলিমের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। বাবার  রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যক্ষের কোনো কাজেরই খেয়াল রাখেন না গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান। সেই সুযোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি দুর্নীতি আর নিজের আখের গোছানোর দাবার কোটে পরিণত করেছেন। তথ্যমতে, ২০২০ সালের মে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধশত শিক্ষক কর্মচারির পিএফ ফান্ডের টাকা কেটে নিয়েছেন তিনি। যার পরিমাণ প্রায় দেড়কোটি টাকা।  এ টাকা কোথায় কোন কাজে ব্যয় করেছেন তার কোনো হিসেব নেই। আবার সে টাকা আজও সমন্বয় করেননি তিনি। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেন তিনি। করোনাকালিন সময়ে শিক্ষক কর্মচারীদের পিএফ ফান্ডের টাকা কাটার পাশাপাশি দুর্যোগপূর্ণ করোনার মাঝে তিনি নতুন শিক্ষক কর্মচারি নিয়োগ দিয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। এসব শিক্ষকদের বেশীর ভাগেরই এনটিআরসি সনদ নেই বলে জানা গেছে। করোনাকালিন সময়ে যখন স্কুল বন্ধ তখন কেন এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হলো আবার কর্মরত শিক্ষকদের পিএফ ফান্ডের টাকা কেন কেটে নেয়া হলো এবং দীর্ঘ সময়ে কেন তা সমন্বয় করা হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ জানান, যা করা হয়েছে তা নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। এর বেশী কিছু বলতে নারাজ তিনি। 

সূত্র বলছে, করোনাকালিন সময়ে যে সকল শিক্ষক কমর্চারী তিনি নিয়োগ দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে চার লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ কারণে শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত এনটিআরসি সনদকেও এড়িয়ে গেছেন তিনি। এসব টাকায় তিনি রাজধানীর ৬১ ইসলামপুরে শ্বশুরের জমির উপর বহুতল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি জিন্দাবাজার প্রসন্ন পোদ্দার লেনের পর্বত মিয়ার বাড়ীতে কিনেছেন কোটি টাকা মূল্যের প্লট। সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে তিনি ননএমপিও শিক্ষকদের শিফ্ট ইনচার্জ করাসহ নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের অবদমন করার নীতি গ্রহণ করেছেন। এতে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না। এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক তদন্ত চেয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিসহ আঞ্চলিক সহকারি পরিচালক, জেলা শিক্ষা অফিসারের বরাবর একাধিক অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অনেকেই। এদিকে কলেজ শাখায় দীর্ঘসময় ধরে প্রাপ্যতা থাকার পরও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য কোনো প্রকার উদ্যোগ না নিয়ে প্রাপ্যতা না থাকার পরও রেজাল্ট টেম্পারিং ও জালিয়াতি করে স্কুল শাখার শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে তিনি এমপিও আবেদন পাঠিয়েছেন। সম্প্রতি একই বাংলা বিষয়ে ৩ জন শিক্ষকের এমপিও আবেদন পাঠান অধ্যক্ষ। এসব আবেদন অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় তা আটকে দিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিস। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ জানান, এসব আবেদন পাঠানো ঠিক হয়নি। আমাদের কাছে এগুলো ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় আমরা তা আটকে দিয়ে এ বিষয়ে ব্যাখা চেয়েছি। 

উল্লেখ্য, এর আগে সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিও নিয়েছেন একই স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সাইফুল বিশ্বাস। সে এমপিওর বিরোধীতা করে শিক্ষামন্ত্রণালয় ডিজি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল শাখায় অভিযোগ দিয়েছেন একই স্কুলের একাধিক শিক্ষক। এ বিষয়ে ঢাকা আঞ্চলিক উপ-পরিচালক সাহারা বেগম জানান, এ বিষয়ে অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টাতে অবশ্যই আমরা তদন্তে যাব। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, আহম্মেদ বাওয়ানী স্কুল এন্ড কলেজ অধ্যক্ষের সকল অপকর্মের দোসর হয়ে কাজ করেছে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের হিসাব সহকারি মো. নাসির উদ্দিন। এই নাসির উদ্দিন পূর্বেও নানা অপকর্মের কারণে জেল খেটেছেন। সেই সাথে অফিস সহকারি থেকে তার চাকুরি অবদমন করে তাকে হিসাব সহকারি করা হয়। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিসে পদায়ন নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এ অফিসে বসেই তিনি পূর্বে বহু অপকর্মের জন্ম দিয়েছেন। জেল খেটে এসে পদ অবদমন হলেও তিনি স্বভাব পাল্টাননি। বরং তা বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েক গুণ। এসব বিষয়ে আহম্মেদ বাওয়ানী স্কুল এন্ড কলেজের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ তদন্তসহ প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষায় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ চান তারা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি অফিস সহকারি আব্দুর রহিমের এমপিওভুক্তিতে বড় ধরনের জাল জালিয়াতি ও ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়েছেন প্রিন্সিপ্যাল মোর্শারফ হোসেন মুন্সি মুকুল। অভিযোগ উঠেছে, আব্দুর রহিমের নিয়োগের সমস্ত প্রক্রিয়া হয়েছে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে। স্কুলের চাহিদা, নিয়োগের বোর্ড গঠন, সেখানে সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতি বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো শর্তই মানা হয়নি এ নিয়োগে। অভিযোগ হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সকল স্তরের কাগজপত্র জাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রিন্সিপ্যাল নিজে তৈরী করেছেন। শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত অভিজ্ঞমহল বলছে, এ চিত্র বিশেষ বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের নয়। এসব সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান চিত্রমাত্র। 

 


আরও পড়ুন