অধিনায়কত্বই কী মমিনুলের অভিশাপ!

news paper

আহমেদ হৃদয়

প্রকাশিত: ১১-৪-২০২২ বিকাল ৬:১৬

5Views

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের অন্যতম একটা ভরসার নাম ছিল মমিনুল হক সৌরভ। টেস্টে অভিষেক হওয়ার পর ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ক্রিকেট বিশে^ সারা জাগিয়েছিলেন এই ব্যাটার। টেস্ট ক্রিকেটে তার নামের পাশে তৈরি হয়েছিল এক আস্থার প্রতীক। ক্রিজে ব্যাটিং করতে আসলে অন্তত একটু স্বস্তি মিলতো। আর জায় হোক, কোনো অঘটন না ঘটলে মমিনুলকে আউট করা এত সহজ নয়।

কিন্তু সেই মমিনুলকে নিয়েই আজ এত সমালোচনা। শুধু তার পারফরম্যান্সই নয়; সমালোচনার তুঙ্গে এখন তার অধিনায়কত্বও। ডারবানে প্রথম টেস্টে টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্তই বা কেন নিলেন মমিনুল তা নিয়েও জল ঘোলা কম হয়নি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে যে ইতিহাস গড়তে চেয়েছিল টাইগাররা; সেই ইতিহাস গড়া না হলেও অন্য একটি ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন ঠিকই মমিনুলের দল। এই মাঠে ভারতকে মুক্তি দিয়ে নিজেরাই এখন সর্বনিম্ন রানের ইতিহাসে। নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন সংগ্রহ হলেও, ডারবানের কিংসমিডে ঠিকই সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহের লজ্জায় পড়েছে বাংলাদেশ। এই মাঠে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ৬৬ রানে অলআউট হয়েছিল ভারত। প্রায় ২৬ বছর পর তাদের মুক্তি দিয়ে ৫৩ রানে গুটিয়ে গেলো বাংলাদেশ। এদিকে দ্বিতীয় টেস্টেও সমালোচনায় মমিনুলের অধিনায়কত্ব। টেস্টে ভালো পিচে বোলারদের সুযোগ আসে কালেভদ্রে। দ্বিতীয় টেস্টের ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই সুযোগ তৈরি করেছিলেন খালেদ আহমেদ। কিন্তু মুমিনুলের রিভিউ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই কেটে গেল আইসিসির বেধে দেওয়া ১৫ সেকেন্ড।

পরে রিপ্লেতে দেখা যায় আউট ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ডিন এলগার। মমিনুলের এই সিদ্ধান্তহীনতা তার অধিনায়কত্ব নিয়ে আরো বেশি সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। এদিকে ডারবানে শেষ ইনিংসে এক ঘন্টা ব্যাটিং করলেও তাও ছিল ৫ম দিন। কিন্তু পোর্ট এলিজাবেথে যে চতুর্থ দিনেই শেষ বাংলাদেশ। এদিনও এক ঘন্টারও কম সময়েই শেষ হয়ে যায় টাইগারদের ইনিংস। ডারবানে ৫৩ রানের পর পোর্ট এলিজাবেথে এবার টাইগাররা অলআউট হয়েছে মাত্র ৮০ রানে। পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে বাংলাদেশের ৩৩২ রানের বড় হার। এটাকে কী লড়াকু বলা যায়! অবশ্যই না। এই ম্যাচে লড়াইয়ের ছিটেফোটাও দেখা যায়নি। পোর্ট এলিজাবেথে দ্বিতীয় টেস্টে জয়ের জন্য ৪১৩ রানের লক্ষ্যে তৃতীয় দিনে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। তৃতীয় দিনে ২৭ রান তুলতেই ৩ উইকেট নেই বাংলাদেশের। চতুর্থ দিনে জয়ের জন্য তখনো দরকার আরো ৩৯৬ রান। কিন্তু চতুর্থ দিনে এক ঘন্টায়ই শেষ বাংলাদেশ। ৮০ রানেই অলআউট। ডারবানে বাংলাদেশকে শেষ দিনে অলআউট করতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বল করতে হয়েছিল ১৯ ওভার। কিন্তু পোর্ট এলিজাবেথে টাইগারদের অলআউট করতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বল করতে হয়েছে ২৩.৩ ওভার। তার মধ্যে চতুর্থ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা হাত ঘুরিয়েছে মাত্র ১৩.৩ ওভার। অবশ্য এদিন ৫৩ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনে ৭ বল খেলার পরই স্লিপে ক্যাচ দেন মুশফিক। তার এক ওভার পর আউট হন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল। দিনের চতুর্থ ওভারে মহারাজের প্রথম বলেই সুইপ করে ছক্কা মারতে গিয়েই আউট হন মমিনুল। ৫০ টেস্টের অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান দলের এমন বিপদের সময় কেনই বা এমন শট খেলতে গেলেন! মুশফিক ও মমিনুল দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের ভরসা। কিন্তু তারা দুজনই এরকম বাজেভাবে আউট হয়ে গেলেন। ইয়াসির আলী; ক্রিজে এসেই সাইমন হারমারকে মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারতে গেলেন। কিন্তু বাউন্ডারি পার করতে পারলেন না। ধরা পড়লেন ফিল্ডারের হাতে। এভাবে টানা তিনটি উইকেট; তবুও লিটনের শিক্ষা হলো না। তিনিও উড়িয়ে মারতে গেলেন মহারাজকে। তবে লিটন তো ব্যাটেই লাগাতে পারলেন না। ২৭ রান করেই স্টামপিং। মেহেদী হাসান মিরাজও উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। এই টেস্টেও ৪০ রানে ৭ উইকেট নেন মহারাজ। ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারমারের।
এবার আসা মমিনুলের ব্যাটিংয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসেই শূণ্য রানে ফেরেন মমিনুল। দ্বিতীয় ইনিংসে তার ব্যাট থেকে আসে ২ রান। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬ রানে আউট হন মমিনুল। আর দি¦তীয় ইনিংসে করেন মাত্র ৫ রান। তবে টেস্টে মমিনুলের এত বাজে পারফরম্যান্স কেন তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।  

২০১৩ সালের ৮ মার্চ শ্রীলঙ্কার গলে তাদের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় মমিনুলের। সেই অভিষেক ম্যাচেই হাফসেঞ্চুরির দেখা পান মমিনুল। প্রথম ইনিংসে ৮৩ বল খেলে করেন ৫৫ রান। সেই ম্যাচেই মুশফিকুর রহিম করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। মোহাম্মদ আশরাফুলের ইনিংস থেমেছিল ১৯০ রানে। নাসির হোসেনও ১৫১ বল থেকে করেন ১০০ রান। সেই থেকে একের পর এক ধারাবাহিক ইনিংস খেলে নজর কাড়ে ক্রিকেট বিশে^র। ২০১৩ সালে ৯ ইনিংসে ৫৮৪ রান আসে মমিনুলের ব্যাট থেকে। সে বছর তার ব্যাটিং গড় ছিল ৮৩.৪। ঐ বছরই ক্যারিয়ার সেরা ১৮১ রানের একটি ইনিংস খেলেন মমিনুল। ৯ ইনিংসে ২ ফিফটির পাশে ছিল দুটি সেঞ্চুরি। পরের বছরটাও একেবারে খারাপ যায়নি মমিনুলের। ২০১৪ সালে ৫১.২ গড়ে ১৪ ইনিংসে মমিনুলের ব্যাট থেকে আসে ৬১৪ রান। ৫ অর্ধশতকের পাশে সে বছরও করেন দুটি সেঞ্চুরি। এরপর কিছুটা থমকে যায় মমিনুলের ব্যাট। ২০১৫ সালে ইনিংস খেলেন ৭টি। ৩৬.৯ গড়ে সে বছর তার ব্যাট থেকে রান আসে মাত্র ২৫৮। অর্ধশতক ছিল দুটি। ২০১৬ সালেও হাসেনি মমিনুলের ব্যাট। ৪ ইনিংসেও তিন অঙ্কের কোটা পেরোতে পারেনি বাঁহাতি এই ব্যাটার। সে বছর ২৩.৫৮ গড়ে রান করেন মাত্র ৯৪। অর্ধশতক ছিল একটি। ২০১৭ সালটাও কেটেছে আগের বছরের মতোই। আগের বছরের ব্যাটিং গড়ের চেয়ে সে বছর খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি মমিনুল। ইনিংস খেলেছেন ১২টি। ব্যাটিং গড় ছিল ২৪.২। সব মিলিয়ে সে বছর তার ব্যাট থেকে মোট রান আসে ২৯০। ১২ ইনিংসে মাত্র দুটি অর্ধশতক ছিল তার। তিন বছর পর ২০১৮ সালে আবারও পুরোনো রূপ ফিরে পায় মমিনুল। সে বছর ১৫ ইনিংসে রান করেন ৬৭৩। তার ব্যাটিং গড়ও ছিল ৪৪.৯। ২০১৮ সালে মমিনুল ৪ টি সেঞ্চুরি করেছেন। সে বছর তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭৬ রানের একটি ইনিংস খেলেন তিনি। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করেন এর পরের বছর। ২০১৯ সালে মমিনুল ইনিংস খেলেন ১০টি। সে বছর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কম ব্যাটিং গড় ছিল মমিনুলের। ১৪.৪ গড়ে সে বছর মমিনুল রান করেন মাত্র ১৪৪। সাথে ছিল মাত্র একটি অর্ধশতক। ২০২০ সালে মমিনুল মাত্র তিনটি ইনিংস খেলার সুযোগ পান। ৬৭.৭ গড়ে সে বছর মমিনুল মোট রান করেন ২০৩। একটি সেঞ্চুরিও ছিল সে বছর। ২০২১ সালটাও একেবারে খারাপ কাটেনি মমিনুলের। ১৩ ইনিংসে তার ব্যাট থেকে মোট রান আসে ৫০১। দুটি সেঞ্চুরির সঙ্গে ছিল একটি হাফসেঞ্চুরি। চলতি বছরটাও খুব একটা ভাল যাচ্ছে না মমিনুলের। এ পর্যন্ত ইনিংস খেলেছেন ৮টি। ২১.৬ গড়ে রান করেছেন ১৫১। হাফসেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন মাত্র একটি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসে মমিনুলের রান মাত্র ২। আর দি¦তীয় টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে মমিনুলের মোট রান ১১। তবে মমিনুলের এমন হাল হওয়ার আসল কারণ কী! যখন তিনি অধিনায়ক ছিলেন না, তখন হয়তো মমিনুলের এত খারাপ অবস্থা ছিল না। অধিনায়ক না থাকা অবস্থায় ৬৭ ইনিংসে মমিনুলের ব্যাটিং গড় ছিল ৪১.৪৮। আর অধিনায়ক হওয়ার পর ২৮ ইনিংসে তার ব্যাটিং গড় কমে নেমে আসে ৩৬.৪-এ। মমিনুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১৫ টি। তা মধ্যে মাত্র তিনটি টেস্টে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ড্র করতে পেরেছে মাত্র একটি ম্যাচ। আর বাকিগুলোতে বাংলাদেশের হার। অধিনায়ক হয়ে বাংলাদেশ দলের জন্য কিংবা নিজের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেনি মমিনুল। তাহলে কী অধিনায়কত্বই মমিনুলের অভিশাপ!

ক্রীড়া সাংবাদিক 


আরও পড়ুন