২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস

news paper

আবুল খায়ের

প্রকাশিত: ২৮-৩-২০২২ বিকাল ৫:২

7Views

এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমন্বিত ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন। বহু ত্যাগ স্বীকার ও প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের সঠিক দিক নির্দেশনায় লক্ষ লক্ষ তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছিল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিশাল ও বিস্তৃত এক শোষণ-বঞ্চনার ধারাবাহিকতার ইতিহাস। 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও আশেপাশের বহু সংখ্যক শিক্ষক ও সাধারণ কর্মচারীদের হত্যা করা হয়। পুরাতন ঢাকার বেশ কিছু এলাকাগুলোতেও চালানো হয় ব্যাপক গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে হত্যা করা হয় পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্যকে। পিলখানার ইপিআর-এর কেন্দ্রে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র সদস্যদের। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত গোলাবর্ষণ করা হয়। অনেক স্থানে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। কিছু কিছু জায়গায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। একই দিনে কয়েকটি পত্রিকা অফিস ভস্মীভূত করা হয়। দেশময় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত নর-নারীকে। ধারণা করা হয়, সেই কাল রাতে কেবল ঢাকা ও তার আশে পাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। 

এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং অনেক স্থানেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই অনেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাবার পর আপামর বাঙালি জনতা পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ (৮ মাস ২০ দিন) মাস একটি প্রশিক্ষিত ও সমরাস্ত্র সজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্যকে চিনিয়ে এনেছি। বিনিময়ে এদেশের ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ ও ২-৩ লক্ষ মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রম’কে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। যদিও ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি’তেই আমাদের স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয় বলে মনে করা হয়। তার মানে স্বাধীনতা অর্জন করতে আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ২৫ মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা বিদবস ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটিকে স্বাীকৃতি জানানোর। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছে বেশ কিছু সংগঠন।
স্বাধীনতার প্রায় ৪৬ বছর পর গত বছর থেকে ২৫ মার্চ দিনকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এছাড়া গণহত্যা দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

অপারেশন সার্চ লাইট বাঙালির ইতিহাসে ও মুক্তিযুদ্ধের এক কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে (যেটাকে কালরাত বলা হয়) ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এই দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।   

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা, এই দিনে জাতি স্মরণ করেছে বীর শহিদদের। স্বাধীনতা দিবস তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার ইতিহাস।পটভূমিতে দেখা যায় যে, ২৫ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে যাওয়ার কারণে ইয়াহিয়া গোপনে ইসলাবাদে ফিরে যান। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ^স্ত সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যায় আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর ও নির্মম আক্রমণের পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্রগ্রামের কালুঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে যান। ঠিক এইভাবে-‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখাইেন থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক’। ২৫ মার্চ থেকে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সকল সাংবাদিককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ০২দিন যাবৎ অবরুদ্ধ করে রাখে। 

গত তিন দশকের বেশী সময় ধরে স্বাধীনতার মূল ঘোষক-কে ছিলেন, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই কারণে ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে একটি ইতিহাস পুস্তক প্রকাশিত হয়। যাতে ৩টি বিষয় উপস্থিত করা হয়। 

১। শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঘোষণাপত্র লিখেন ২৫ মার্চ মাঝরাত কিংবা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে।
২। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাপত্রটি ২৬ তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। কিন্তু সীমিতসংখ্যক মানুষ সেই সম্প্রচারটি শুনেছিল।
৩। পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচার করে। ইংরেজীতে প্রচারিত হওয়ার ফলে বিশ^ বিবেক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারে। 
ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ-আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। এটি আরও ঘোষণা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমি সেই কারণে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে বিশে^র সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশেষ করে বৃহৎ বিশ^ ও প্রতিবেশীদের কাছে কার্যকারী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার ফলে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়েছে। অধিকাংশ জনগণের বৈধভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিপীড়নকারী, এটি একটি ক্রুর কৌতুক ও মিথ্যা অপবাদ যার কাউকে বোকা বানানো উচত নয়। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রধান পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথম হতে হবে নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয় শান্তি এবং তৃতীয় সকলের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন ও কারো সম্বন্ধে অজ্ঞানতা নয়। -আল্লাহ্ সহায় হোক, জয় বাংলা। 

এরপর মেজর জিয়াউর রহমানের আরো দু’টি ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৮ ও ৩০ মার্চ প্রচারিত হয়। মেজর জিয়ার ভাষণ সম্পর্কে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তৎকালীন মেজর সুবিদ আলী ভুঁইয়া লিখেছেন, তাঁর (জিয়ার) দ্বিতীয় দিনের ভাষণে এ তথ্যই প্রকাশ পায় যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস, মেজর এসএ ভুঁইয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪, পৃ:৪৪-৪৫)। 
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
তলাবিহীন ঝুড়ির সেই বাংলাদেশ আজ বিশে^র জন্য একটা রোল মডেল। বাংলা ভাষা আজ সারা বিশ^বাসীর জন্য মর্যাদাবান ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। স্বল্প উন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। কিভাবে সম্ভব হয়েছে একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। সিকিম অথবা পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতা না থাকার কারণে তারা জানেন স্বাধীনতার স্বাদ কী জিনিস। আমরাও পরাধীনতার শৃঙ্গলকে গুড়িয়ে দিয়ে নিজের স্বাধীনতার সূর্যকে অবমুক্ত করার মাধ্যমে বিশ^দরবারে আজ বাঙালি মর্যাদার আসনে আসতে পেরেছি। 

তবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। যতোদিন আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে না পারবো, ততোদিন স্বাধীনতার মতো পবিত্র আমানত’কে জনগণ উপভোগ করতে পারবে না। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারলে লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। বাংলা মায়ের চলার পথ হোক কুসুমাস্তীর্ণ। সমস্ত উগ্রবাদীতার বিনাশ হোক। মানবতার বিজয় অবিসম্ভাবী। 
লেখক: কবি ও কলামিস্ট

 


আরও পড়ুন