ঠিকাদার-প্রকৌশলী আঁতাত

আজিমপুরে সরকারী ভবন মেরামতের নামে হরিলুট

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২০-১-২০২২ রাত ৮:৪১

51Views

রাজধানীর আমিজপুর গণপূর্ত বিভাগ ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদের বিরুদ্ধে ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়া ও ভবন ঝুঁকিপূর্ণর নোটিশ দেয়া এবং পুনরায় মেরামতসহ নানাভাবে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, এই প্রকৌশলীর বাড়ি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন মন্ত্রীর এলাকায় হওয়ায় তিনি দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর একই জায়গায় অবস্থান করছেন। এর ফলে পচ্ছন্দের ঠিকাদারদের দিয়েই নানা অনিয়মের মাধ্যমে কমিশন বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান প্রকৌশলী গণপূর্ত অধিদপ্তর ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, লালবাগ থানাধীন আজিমপুর সরকারী কলোনির (মৌচাক) সর্বমোট ১০টি আবাসিক ভবন রয়েছে। এরমধ্যে নতুন ৩৭ ও নতুন ৩৮ ভবন দুটি অধ্যাধিক নাজুক জরাজীর্ণ অবস্থার নোটিশ করা হয়। ভবন দুটিতে নিয়মিতভাবে অভ্যন্তরীণ সিভিল, স্যানেটারী মেরামত কাজ করা হয়। ফলে ব্যবহারের উপযোগী মর্মে বিবেচনা করা হলেও বহিরস্থ অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার প্রয়োজন এবং একই সাথে ঝুঁকি বিবেচনায় ভবন দুটি অপসারণ করা জরুরি উক্ত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এরপর স্মারক নং ২৫,৩৬,২৬০০--২১০৪-এ বলা হয়, আজিমপুর সরকারি মৌচাক কলোনির ভবন নং ৩৭ ও ৩৮ নতুন ভবন অতি পুরাতন ও জরাজীর্ণ। উক্ত ভবন দুটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পুলের আওতায় বরাদ্দকৃত মোট ৪৮টি ফ্ল্যাটে বসবাসকারী কর্মচারীগণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় স্ব-পরিবারে বসবাস করার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া, বাসাগুলোর সিলিংয়ের বিভিন্ন অংশে আরসিসি ছাদের চাক খসে পড়ার কথা এবং ভবনে বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছে। 

শুধু তাই নয়, উক্ত ভবন দু’টি গেটে নোটিশ টাঙানো হয়েছে। ওই নোটিশে বলা হয়েছে, এতদ্বারা সম্মানিত এলোটী-গণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগ, ঢাকার স্মারক নং ২৫,৩৬--২১০৪ তারিখ ২০-০৯-২০২১ খ্রি. অনুযায়ী মৌচাক কলোনীর ৩৭ (নতুন) ভবনটিকে দুর্ঘটনাপ্রবণ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে এলোটীগণকে অন্যত্র বরাদ্দ প্রাপ্তির জন্য সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের সাথে জরুরী ভিত্তিতে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। অথচ উক্ত ভবন দু’টি ঠিকাদারের মাধ্যমে তা মেরামত করা হচ্ছে। আবার ২৫,৩৬,--২২২১ নম্বর স্মারকে বলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমদ স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়েছে, আজিমপুর সরকারি কলোনী (মৌচার ও দক্ষিণাঞ্চল) এর অভ্যন্তরে বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ ( জোন সি ও জোন ডি) শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থাপত্য নকশা সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। অথচ বিভিন্ন ভবন মেরামতের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা অর্থ অপচয় করা হচ্ছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর টেন্ডার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য ইজিপি প্রক্রিয়া চালু করেছেন। সাধারণত ইপিপিতে ছোট কাজ (এপিপিযুক্ত) ১ কোটি টাকার নিচের কাজগুলো এলটিএম পদ্ধতিতে টেন্ডার আহ্বানের নিয়ম। এলটিএম টেন্ডার পদ্ধতিতে অধিক সংখ্যক টেন্ডার সিডিউল বিক্রি হওয়ার ফলে সরকার বেশী পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদ দুর্নীতি করে প্রতিটি কাজের ২৫ শতাংশ টাকা নিয়ে টেন্ডারগুলো ওটিএম পদ্ধতি টেন্ডার আহ্বান করে রেইটকোট ও বিভিন্ন শর্ত দিয়ে কাজগুলো তার পচ্ছন্দের কয়েকজন ঠিকাদারকে পাইয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে কাজের গুণগত মান নিম্নমানের এবং সরকার রাজস্ব হতে বঞ্চিত হচ্ছে। আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগ গত দুই তিন বছর ধরে ইজিপি পদ্ধতিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি করে পচ্ছন্দের কয়েকজন ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর ব্যক্তি স্বার্থে পছন্দের ঠিকাদারদের মধ্যে মেসার্স মোস্তাফিজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকজন ঠিকাদারকে অনৈতিক উপায়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু গত অর্থ বছরে মেসার্স মোস্তাফিজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার কাজ করেছেন। ঠিকাদারদের লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে সরকারকে আয়কর ট্রেড লাইসেন্স, ডিপার্টমেন্ট লাইসেন্স নবায়ন করতে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করা সাধারণ ঠিকাদারগণ টেন্ডার ড্রপিং করতে পারছে না। এভাবে কোন কাজ না পাইলে বা ড্রপিং করতে না পারলে ভবিষ্যতে লাইসেন্স নবায়ন করতে সম্ভব হবে না। এতে সরকার লাইসেন্স নবায়নের রাজস্ব হতে বঞ্চিত হবে। আর সাধারণ ঠিকাদারগণ ঠিকাদারী ব্যবসা থেকে ঝরে পড়বে। 

প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা আনতে ইজিপি পদ্ধতি চালু করেছেন। অথচ দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ব্যক্তি স্বার্থের কারণে প্রধানমন্ত্রীর সেই মহতি উদ্দ্যেগ ব্যাহত হচ্ছে। স্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া না হওয়ায় বঞ্চিত ঠিকাদারগণ আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগে গত দুই বছরের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত পূর্বক দায়ী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

ইডেন কলেজের পশ্চিম পার্শ্বের অফিসার্স কোয়াটারগুলো টাইলস লাগানোসহ বিভিন্ন কাজে ইজিপি তে না দিয়ে ২৫ শতাংশ টাকা আদায় করেছেন। কিন্তু ঠিকাদারদের ওই কাজ না করেই তাদের কাছ থেকে ভাগ আদায় করেছেন সংশ্লিষ্ট জানিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, যেসব স্থাপনা নির্মাণে কমিশন, উৎকোচ বা সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে না, সেখানে মেরামত বা নির্মাণ করা হয়। তার প্রমাণ আজিমপুর এলাকায় সরকারি কোয়ার্টারের দেয়া চাপা পড়ে বাবার হাত থেকে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা। গত ৯ নভেম্বর আজিমপুরে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার পথে দেয়াল চাপা পড়ে জিহাদ (৭) নামের ওই শিশুর মৃত্যু হয়। জিহাদ লালবাগ শহীদ নগর এলাকার পান বিক্রেতা নাজির হোসেনের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট ছিল। এ ঘটনায় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেয়া হবে তা জানতে হাইকোট বেঞ্চ এক রুল জারি করেছে। শিশুটির বাবা ও আইন অধিকার (বিডি) ফাউন্ডেশনের করা রিটের শুনানি নিয়ে গত ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

শিশুর বাবা নাজির হোসেন জানিয়েছেন, তার ছেলে শিশু জিহাদ আজিমপুর দিবাকালীন শিশু যত্ন কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণিতে পড়তো। প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিনও সকালে ছেলের হাতে ধরে শেখ সাহেব বাজার সরকারি কলোনির পাশ দিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় কলোনির বাউন্ডারির দেয়াল ধসে পড়লে চাপা পড়ে জিহাদ। এ অবস্থায় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ছেলেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ব্যাপারে আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমদের সেলফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।


আরও পড়ুন