প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে রঙিন পাখি মাছরাঙা

news paper

বারহাট্টা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৫-৭-২০২৫ দুপুর ৩:৫২

63Views

আবহমান বাংলার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করলেও, এই সৌন্দর্য বর্ধনের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি। এদের মধ্যে গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে অতি পরিচিত রঙিন পাখি মাছরাঙা। কিন্তু কালের বিবর্তন আর মানুষের অসচেতনতার কারণে আজ বিলুপ্তির পথে দৃষ্টিনন্দন এই রঙিন পাখি।

সুকুমার রায়ের কবিতায় মাছরাঙার চিরায়ত রূপ ও রঙের অসাধারণ প্রতিচ্ছবি দেখা যায়: "রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে, অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে? মাছরাঙা! তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি? রকম-সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি!" আসলেই রঙের বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও পরিচিত পাখি মাছরাঙা। এক সময়ে নদ-নদী, বিল-ঝিল, ধানি জমি ও পুকুরপাড়ে দেখা যেত মাছরাঙার অবাধ বিচরণ। বাঁশের খুঁটিতে অথবা গাছের ডালে ওতপেতে বসে পানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে যখন শিকারের আশায় চুপ করে বসে থাকে, তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা কোনো চিত্রকর্ম। এরা অনেক ধরনের প্রাণী শিকার করে, তবে তার বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে মাছ। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরীসৃপ ইত্যাদি।

সরেজমিনে উপজেলা সদরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান, প্রতিটি এলাকাতেই নির্জন দুপুরে পুকুর কিংবা কোনো জলাশয়ের আশেপাশে ছোট গাছের চিকন ডাল বা বাঁশের খুঁটির ওপর স্থির অপেক্ষায় বসে থাকা উজ্জ্বল রঙের পাখি মাছরাঙা চির পরিচিত গ্রামীণ রূপ। মাছের অবস্থান টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীরগতিতে পানির নিচে মাছের ওপর মাথা নিচু করে ঝাঁপিয়ে পড়তো মাছ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাছরাঙা তাকে ধরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর পাখিটির ঠোঁটের ফাঁকে ছোট্ট একটি মাছ ছটফট করতে দেখা যেত, এরপর কয়েকবার আছাড় মেরে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে মাথার দিক থেকে গিলে ফেলার দৃশ্য। শিকারের সন্ধানে আবার চিচি...চিচি.. শব্দে জলাশয়ের ধার ধরে উড়ে চলতো। জমি, পুকুর, খাল-বিলে রাসায়নিক সার মিশ্রিত খাবার খেয়ে পাখির সংখ্যা ও ডিম দেয়ার পরিমাণ কমে যাওয়া, ঝোপ-ঝাড় ও গাছপালা কেটে ফেলায় নিরাপদ আবাসস্থলের অভাব, বিভিন্ন কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে রঙিন পাখি মাছরাঙা।

বারহাট্টা সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রভাষক মজিবুল হক বলেন, মাছরাঙা 'Coraciiformes' বর্গের অন্তর্গত অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙের ছোট বা মাঝারি আকৃতির একটি পাখি। মাছরাঙার বৈজ্ঞানিক নাম- 'Alcedo atthis' এবং এর ইংরেজি নাম- 'Kingfisher'। বাংলাদেশে প্রায় ১২ প্রজাতির মাছরাঙা রয়েছে, যেমন- ছোট নীল মাছরাঙা, সাদা বুক মাছরাঙা, লাল মাছরাঙা, ছিট/পাকড়া মাছরাঙা, মেঘ হও মাছরাঙা, সবুজ মাছরাঙা, কালো মাছরাঙা, বাদামি মাছরাঙা, দারুচিনি মাছরাঙা, নীল কানের মাছরাঙা, সাদা গলা মাছরাঙা, বুনো মাছরাঙা। এদের প্রায় সবারই দেহের তুলনায় মাথা বড়, লম্বা, ধারালো ও চোখা চঞ্চু, খাটো পা ও খাটো লেজ রয়েছে। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের আর স্ত্রী-পুরুষে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়।

তিনি আরও বলেন, এদের প্রজনন মৌসুম শুরু হয় বর্ষার শেষে কিংবা শরতের শুরুতে। এ সময় এরা জোড়বেঁধে একত্রে থাকে। একসঙ্গে পাঁচ থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো দেখতে চকচকে সাদা। বাবা ও মা পাখি উভয়ই ডিমগুলিতে দিনের বেলা তা দেয়। তবে রাতের বেলায় ডিমগুলিতে তা দেয় শুধু মা পাখি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ১৯-২০ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা আরও ২৪-২৫ দিন বাসায় থাকে। বাসা তৈরি থেকে বাচ্চার যত্ন নেওয়া পর্যন্ত সব কাজই বাবা-মা মিলে করে। এদের প্রিয় খাবার ছোট মাছ, জলজ পোকা-মাকড় এবং ব্যাঙাচি। পুকুরের পাড়ে বা খাড়া মাটির পাড়ে এক ফুট দীর্ঘ গর্ত করে এ পাখি বাসা তৈরি করে। গর্তের শেষ প্রান্তটি প্রশস্ত হয়। এ বাসায় মাছরাঙা ৫-৬টি ডিম পাড়ে। ডিমের রং সাদা।

বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল ও কলেজ) বাংলা বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক ও দৈনিক খবরের কাগজ পত্রিকার সাংবাদিক বিজয় চন্দ্র দাস বলেন, এক সময়ে পুকুর বা জলাশয়ের ধারে চিকন গাছ কিংবা বাঁশের খুঁটিতে মাছ শিকারের আশায় বসে থাকা অথবা এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে চলা মাছরাঙা পাখি দেখলে গ্রামের প্রকৃত রূপ ফুটে উঠতো। কিন্তু দিনদিন পাখির সংখ্যা কমতে থাকায় এখন আর আগের মতো সেই রূপ ধরা পড়ে না। এই পাখির শিকার ধরার কৌশলও বেশ অদ্ভুত। পানির ওপর ঝুঁকে পড়া কোনো চিকন ডাল বা পানিতে পুঁতে রাখা বাঁশ-খুঁটির ওপর বসে নিচে মাছের গতিবিধির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি। তাক সই হলেই ঋষির ধ্যান ভেঙে যায়। ঝুপ করে তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছটিকে ধরে ফেলে। গ্রিক পুরাণের সেই কিংবদন্তি হ্যালসিওন পাখি বা মাছরাঙা বৈশ্বিকভাবে বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত। বন উজাড় করার ফলে মাছরাঙার আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া জলাভূমি কমায় ফলে আমাদের চারপাশে অবাধে বিচরণ করা পাখিটির বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষায় সম্মিলিতভাবে আমাদের এগিয়ে আসা দরকার।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা সাদিকুল ইসলাম বলেন, আগে যে পরিবেশে প্রাণীকূল নিরাপদে বসবাস করত, তা এখন আর নেই। নানা কারণে মাছরাঙাসহ অনেক প্রাণীই আজ বিপন্ন হচ্ছে। প্রথমত মাছরাঙা পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে পরিবেশ দূষণ দায়ী। নানাভাবে আমাদের জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মাছ চাষে জলাশয়ে বিষ প্রয়োগে পানি দূষিত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী। ফলে মাছরাঙার খাবারের সংকট দেখা যাওয়াসহ দূষিত পানিতে বিষক্রিয়া হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছরাঙার বাসা তৈরির সুযোগ কমে যাওয়ায় এই ধরনের পাখির সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। প্রত্যেকটি প্রাণী সংরক্ষণে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।


আরও পড়ুন