কুষ্টিয়াবাসীর মাঝে আবারো সেই ৯০ দশকের চরমপন্থী আতঙ্ক
প্রকাশিত: ১০-৭-২০২৫ দুপুর ১:৫
চরমপন্থী শব্দটি এ প্রজন্মের কাছে খুব পরিচিত না হলেও, ৯০ দশকের মানুষরা এর সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিল। এর কারণ ছিল ৯০ দশকে চরমপন্থীদের এতটাই আধিপত্য ছিল যে তারা রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ভিন্ন রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। সেই সময় শিক্ষিত বেকার যুবকদের অধিকাংশই ক্ষমতার আধিপত্য ও লোভ-লালসার কারণে চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। চরমপন্থীদের মধ্যে সর্বহারা, বাংলাদেশ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, হক গ্রুপ, লাল পতাকা সহ একাধিক শক্তিশালী সংগঠন ছিল। এই সংগঠনগুলো বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হলেও "কেউ দশতলায় কেউ গাছতলায় তা হবে না, সবার সমান অধিকার" — এই আদর্শে তারা সবাই এক ছিল। তবে কিছু কিছু সংগঠন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও আখের গোছানোর জন্য বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে চলতে চলতে একসময় সব সংগঠনই নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিয়মিত প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও হত্যা চালাতে থাকে, ফলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করে। এই সময়ে চরমপন্থী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়।
চরমপন্থীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং একসময় তারা থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন ব্যাংকের শাখাগুলোতে ডাকাতি শুরু করে। এদের নিয়ে সরকারের উদ্বেগ বাড়তেই থাকে। এরপর তৎকালীন সরকার সারাদেশে বিশেষ অভিযান শুরু করে এবং এই অভিযানের মধ্য দিয়েই সারা দেশের চরমপন্থী নেতা ও সদস্যরা র্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত হয় বা গ্রেপ্তার হয়। এরপর থেকে চরমপন্থী সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যায় এবং দিন দিন এদের বিচরণ আর দেখা যায় না।
চরমপন্থীদের সে সময়ের কথা এ প্রজন্মের তরুণদের কাছে রূপকথার গল্প মনে হলেও তা ছিল সম্পূর্ণ সত্য। দীর্ঘদিন এদের কর্মকাণ্ড ও পদচারণা দেখা না গেলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়ায় চরমপন্থীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একসময় এই জেলাতেই বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং তাদের বেপরোয়া চলাচল ছিল। বর্তমানে কুষ্টিয়ার মানুষ আবার নতুন করে চরমপন্থীদের আতঙ্কে ভীত। প্রতিনিয়তই জেলার বিভিন্ন বালুমহলে সশস্ত্র অবস্থায় এদেরকে দেখা যায়। কিছুদিন আগে জেলার কয়া ইউনিয়নে বালুমহলে চরমপন্থীরা বালুমহলের ম্যানেজারকে গুলি করে টাকা পয়সা লুটে নিয়ে যায়। জেলার বড় বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারকে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়। সব মিলিয়ে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চরমপন্থীদের গুলিতে নিহতদের মধ্যে ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া জেলা সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘটিত ত্রিপল মার্ডার অন্যতম। এই হত্যাকাণ্ডের পর এক প্রভাবশালী চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনী পক্ষ থেকে চরমপন্থী নেতা কালু হত্যার দায় স্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার মধুপুর বাজারের এক প্রবাসীকে গুলি করে হত্যা সহ গত দশ মাসে কুষ্টিয়া জেলায় চরমপন্থীদের হাতে বেশ কয়েকজন হত্যার শিকার হন এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিয়মিত চাঁদাবাজি ও অস্ত্র মহড়া চলছে, আবারো যেন সেই ৯০ দশকের মতো মেতে উঠেছে চরমপন্থীরা। এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার কিছু ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা ভয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যান। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার দৈনিক সকালের সময়কে জানান, সেই আগের মতোই আবার চরমপন্থীরা অত্যাচার শুরু করেছে; তাদের কথার বাইরে গেলে কাজ বন্ধ করে দেয়, সাইডে লুটপাট চালায় এবং হত্যার হুমকি সহ পরিবারের সদস্যদের কিডন্যাপের হুমকি দেয়। দীর্ঘ অনেক বছর তারা শান্তিতে ব্যবসা করলেও এখন তার উল্টোটা, এখন বিভিন্ন গ্রুপে চাঁদা দিয়ে দিনশেষে তাদেরকেই ঋণগ্রস্ত হতে হয়। তারা প্রশাসনকে এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আবার সেই আগের মতো এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স জারি করার দাবি জানিয়েছেন, কারণ সন্ত্রাসীরা কারো ভাই, কারো আত্মীয় বা কোনো দলের নয়, তাদের বড় পরিচয় তারা সন্ত্রাসী।
কুষ্টিয়ায় যখন চরমপন্থীদের বেপরোয়া চলাচল, তখন যৌথবাহিনী ইতিমধ্যে কুষ্টিয়াতে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে একসময়ের চরমপন্থী নেতা ও কুষ্টিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপটন সহ তার দুই সহযোগী প্রচুর পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র সহ সেনাবাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হন। এছাড়া ইন্টারপোলের আসামি ও বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত ব্রাইম সহ তার দুই সহযোগী শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও গ্রেপ্তার হন। প্রতিনিয়তই চরমপন্থীরা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অস্ত্রসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও দিন দিন চরমপন্থীদের বেপরোয়া চলাচল ও রাজনৈতিক দলের রেষারেষিতে কুষ্টিয়া উত্তপ্ত হচ্ছে।
সন্ত্রাসীরা একের পর এক গ্রেপ্তার হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে প্রশ্ন তুলছে সাধারণ জনগণ। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, কুষ্টিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপটন সহ তার দুই সহযোগীকে ছয়টি বিদেশি পিস্তল, একটি ব্রুয়েল গান, বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ সহ যৌথবাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে লিপটনকে প্রধান আসামি উল্লেখ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু মামলার এজাহারে লিপটনকে প্রধান আসামি থেকে বাদ দিয়ে তার সহযোগীদেরকে প্রধান আসামি করা হয় এবং এজাহারে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিতেও গরমিল রয়েছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে একটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সমালোচনা সৃষ্টি হয় ও রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুষ্টিয়ার একজন সিনিয়র সাংবাদিকের কাছে প্রশ্ন করলে তিনি দৈনিক সকালের সময়কে বলেন, একসময় চরমপন্থীদের আতঙ্কে কুষ্টিয়াবাসী অতিষ্ঠ ছিল, কিন্তু দীর্ঘ বছর এদের পদচারণা এতটা না থাকলেও কিছুটা ছিল যা ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায়। এই লিপটন একজন সরকারি বাহিনী, আমি যা মনে করি কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদরের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব আলম হানিফের কাছের লোক ও ক্যাডার ছিল। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে লিপটন আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপির কুষ্টিয়া জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব জাকির সরকারের আস্থাভাজন হয়েছে। এ নিয়ে জেলার রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন বিএনপি নেতা জাকির সরকার। এমন ঘটনা এখানেই শেষ নয়, জেলার বিভিন্ন চরমপন্থী নেতা ও সদস্যরা গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এই চরমপন্থীদের সক্রিয় ভূমিকা ও তাদের কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলেও প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্তা ব্যক্তি ও অসৎ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের কারণে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চরমপন্থীরা—এমনটিই দাবি করেন কুষ্টিয়ার সচেতন নাগরিকরা। তাদের এমন দাবি একেবারে অগ্রহণযোগ্য নয়, যার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ অনুসন্ধানে উঠে আসে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার চরমপন্থী সংগঠন সেভেন স্টার গ্রুপ ও খোকসা থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার আচরণে। খোকসা খেয়া ঘাটে চাঁদা দাবি ও হামলার ঘটনা, খোকসা থানার পাশে জুয়েলার্স এর দোকানে ফিল্ম স্টাইলে দুর্ধর্ষ চুরি, উপজেলার পাতিলডাঙ্গা গ্রামে যুবককে লক্ষ্য করে গুলি ও হামলার ঘটনায় খোকসা থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নীরব ভূমিকা যার ফলে প্রশাসনের প্রতি প্রশ্ন তুলছে সাধারণ জনগণ। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান দৈনিক সকালের সময়কে বলেন, "আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি, ইতিমধ্যে বিভিন্ন চরমপন্থী দলের চরমপন্থী নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। এবং আমাদের অভিযান চলমান, আমরা আশা করি অতি দ্রুত এদের সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।"
কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলা চরমপন্থীদের অভয় অরণ্য কারণ এটি বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী উপজেলা। আর এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বর্ডারকে কেন্দ্র করে অস্ত্র, মাদক, চোরাচালানের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে এই চরমপন্থী নেতারা এবং এই উপজেলায় পদ্মা নদীর দুর্গম চর ও হাওয়ায় চরমপন্থীরা এই উপজেলাটিকে বেশি নিরাপদ মনে করে। শুধু দৌলতপুরই নয়, কুষ্টিয়া সদর উপজেলা ও ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে চরমপন্থীদের রয়েছে একটি বড় নেটওয়ার্ক। চরমপন্থীদের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে চায় কুষ্টিয়াবাসী। লালনের জেলা ও সাংস্কৃতিক রাজধানী এই শান্তিপ্রিয় কুষ্টিয়াবাসী শান্তিতে বসবাস করতে চায়—এটিই তাদের দাবি।