‘বস্তাপ্রতি ভাড়া পুনঃনির্ধারণের দাবি’
উত্তরাঞ্চলে হিমাগারের ফাঁদে আলুচাষিরা কাঁদে!
প্রকাশিত: ৯-৭-২০২৫ দুপুর ৩:৩৫
দেশের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলে আলু সংরক্ষণে হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) ভাড়া বৃদ্ধিতে বিপাকে চাষিরা। গত এক বছরের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৭০-৮০ টাকা। অনুকূল আবহাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদন মৌসুমে ব্যাপক দরপতন ও কৃষি উপকরণের বাড়তি দরে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর আগে থেকেই লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। অতিরিক্ত ভাড়ায় আলু সংরক্ষণ করে মূলধন হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন অনেকেই। কীভাবে টিকে থাকবেন তা নিয়েই চিন্তিত আলুচাষিরা। তারা বলছেন, এতে চাষিদের কোটি টাকার লোকসান হবে। এটি সিন্ডিকেটের কাজ; যা ভেঙে দেয়া অত্যন্ত জরুরি। ক্ষতির মুখে চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন চাষিরা। ফলে অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। হিমাগার মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত হিসাবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আর কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বগুড়া অঞ্চলে। ডিএই’র বগুড়া অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত মৌসুমে এই কৃষি অঞ্চলের জয়পুরহাট, বগুড়া, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ১ লাখ ৭ হাজার ৫২৮ হেক্টর জমি থেকে ২৪ লাখ ৬৯ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে ৭৪টি, যার ধারণক্ষমতা ৬ লাখ ৪৫ হাজার ২৩৮ মেট্রিক টন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ঢাকার পুরানা পল্টনে নিজদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কেজিতে ১ টাকা বাড়িয়ে ৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল, যা গত বছর ছিল ৭ টাকা। এ ছাড়াও এক বস্তায় ৫০ কেজির বেশি রাখা যাবে না বলে ঘোষণা দেন তারা। এতে জনমনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে রাজপথে আন্দোলনে নামেন আলুচাষিরা। এরই ধারাবাহিকতায় মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক অবরোধ ও রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ প্রদর্শণ করেন। এরপর হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় সরকার। গত ২ মার্চ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ রেজা আহমেদ খানের সই করা অফিস আদেশে কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ এর ১৬ (খ) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দেশের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৬ টাকা ৭৫ পয়সা হারে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
এদিকে, দেশের অন্যতম আলু উৎপাদনকারী জয়পুরহাট জেলার হিমাগারগুলোতে আলু বিক্রির মৌসুম পুরোদমে শুরু হতে না হতেই হিমাগার ভাড়া বাড়ানো এবং বাজারে অস্থিরতায় জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আবারও আন্দোলনে নেমেছেন তারা। সব মিলিয়ে হিমাগারমালিক ও আলুচাষিরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। গত ২৯ জুন জেলার কালাই উপজেলার পৌরশহরের আর.বি কোল্ড স্টোরেজের সামনে আলুচাষি ও আলুব্যবসায়ীদের ব্যানারে মানববন্ধন শেষে ঘণ্টাব্যাপী জয়পুরহাট-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তিতে পড়েন পথচারীরা। পরবর্তীতে থানার ওসি ও ইউএনও ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। জয়পুরহাট জেলার ২১টি হিমাগারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি হিমাগার এ উপজেলায় অবস্থিত। এসব হিমাগারে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষিত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
কৃষকদের অভিযোগ- আলু উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও সংরক্ষণে হিমাগার ভাড়া বৃদ্ধিতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হিমাগারমালিক, আড়তদার ও মৌসুমী ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি হচ্ছে। প্রচলিত রীতি-অনুযায়ী বস্তা (৬০-৬২ কেজি) চুক্তিতে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেন এখানকার কৃষকরা। প্রতিবস্তায় ৫০ কেজি হিসেবে হিমাগারমালিকদের ভাড়া পরিশোধ করে আসছেন তারা। গত বছর বস্তাপ্রতি আলু সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। এবার সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কেজিতে ভাড়া নির্ধারণ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। কাগজে কলমে সরকারি হিসাবে গতবারের চেয়ে কেজিতে ২৫ পয়সা কমিয়ে ৬ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও হিমাগারমালিকরা বস্তা ওজন করে ভাড়া আদায় করায় উল্টো বস্তাপ্রতি ৭০-৮০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে কৃষকদের। এলাকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ি বস্তা চুক্তিতে হিমাগার ভাড়া নির্ধারণ করার দাবি তাদের। সম্প্রতি হিমাগার ভাড়া পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে প্রেস সচিবের মাধ্যমে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছেন জয়পুরহাটের কৃষকরা। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
কালাই উপজেলার আব্দুল হান্নান নামের এক কৃষক বলেন, এই হারে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হলে কৃষকদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এটি একটি সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেটের কাজ, যা ভেঙে দেওয়া জরুরি। আলু ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, ভাড়া বাড়ানোর ফলে লোকসান আরো বেড়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণ খরচ, বস্তা, সুতলি, শ্রমিক, পরিবহন খরচ; সবমিলে এক বস্তা আলু সংরক্ষণে খরচ পড়েছে ১১০০-১১৫০ টাকা। অথচ তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০ টাকায়। প্রতিবস্তায় ৩০০-৩৫০ টাকা লোকসান হচ্ছে। কৃষক শাহাদুল ইসলাম ও আব্দুল রশিদ বলেন, এবার ৫০০ বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছি আর.বি কোল্ড স্টোরে। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে প্রতি বস্তা ৪৩০ টাকা। অথচ মৌসুমের শুরুতে প্রশাসনের চাপে ৩৫০ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী বগুড়ার হিমাগারগুলোতে প্রতিবস্তা আলু সংরক্ষণের ভাড়া প্রতি বস্তা ৩৫০-৩৬০ টাকা। আরবি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের এমডি প্রদীব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে ৪১০ টাকা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৪২০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে প্রতিবস্তায় ৩৫০ টাকা নেওয়া হবে বলে দাবি তার।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর পত্র প্রেরণ করেছেন। জানতে চাইলে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহা. সবুর আলী বলেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে একটি মধ্যস্থতা করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর এই বিষয়ে কোন সমস্যা নেই। বস্তা চুক্তিতে প্রচলিত রীতি উপেক্ষা করে কেজিপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহানা আখতার জাহান মুঠোফোনে বলেন, এ ব্যাপারে কেউ লিখিত আবেদন করলে তিনি বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন।