খাগড়াছড়ি পার্বত্য পরিষদে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ, দুদকে চেয়ারম্যান ও তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ
প্রকাশিত: ৮-৭-২০২৫ দুপুর ৪:২০
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ নতুন নয়। এরই মধ্যে সেই অভিযোগ পৌঁছেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকে)। পরিষদের চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য, পিসি, ফাইলের বিপরীতে পার্সেন্টেজ আদায় এবং চেকের বিপরীতে অর্থ লেনদেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও ৭ জুলাই অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে সকল কার্যক্রম স্থগিত করে পরিপত্র জারি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এদিকে, সম্প্রতি খাগড়াছড়ির মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগারের সাধারণ সদস্য মো. আরাফাত হোসেন রিজভী দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অর্থছাড়ের বিপরীতে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে বরাদ্দের ১০ শতাংশ, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ'র বিরুদ্ধে ৫ শতাংশ, নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ানের বিরুদ্ধে ৫ শতাংশ এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আশীষ চাকমার বিরুদ্ধে ২ শতাংশ পার্সোনাল কমিশন বা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘুষ না পেলে ফাইল চলে না, হয়রানি সহ নানা সমস্যায় পড়তে হয় বলেও অভিযোগের শেষ নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক আবেদনে মো. আরাফাত হোসেন রিজভী উল্লেখ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগার কেন্দ্রের উদ্যোগে গ্রুপ ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচি পালনের ১৫৫ নম্বর প্রকল্পে সর্বমোট ৫০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেছিল। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বরাদ্দ ছিল ৩০ লাখ টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বরাদ্দ ২০ লাখ টাকা। প্রকল্পের উন্নয়ন স্কিম প্রণয়ন (ডিএসপি) প্রস্তুতের জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের কাগজ নিয়ে জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ানের কাছে গেলে তিনি 'টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না' বলে জানিয়ে দেন। এরপর থেকেই ধাপে ধাপে হয়রানি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বরাদ্দের বিপরীতে চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা ১০ শতাংশ, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ ৫ শতাংশ, নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান ৫ শতাংশ, এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে নিয়োজিত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আশীষ চাকমা ২ শতাংশ কমিশন দাবি করেন। দাবি করা ঘুষ প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোয় নানাভাবে হয়রানি করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেট ৩০ লাখ টাকার মধ্যে অগ্রিম ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা অর্থ ছাড়ের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শেফালিকা ত্রিপুরা গত ১৩ মে আবেদন করেন। কিন্তু প্রকল্পে ঘুষ না পাওয়ার কারণে চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা উত্তেজিত হয়ে গত ২ জুন সহকারী প্রকৌশলী অপু বড়ুয়ার শার্টের কলার ধরে তাকে অপমান করেন। এরপর মিসেস শেফালিকা ত্রিপুরাকে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন। এরপরও নানা রকম হয়রানি অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর করা আবেদনপত্রে।
খাগড়াছড়ির মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগারের সাধারণ সদস্য মো. আরাফাত হোসেন রিজভী বলেন, "আমার অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণসহ দুদক চেয়ারম্যানের কাছে গত ৬ জুলাই ডাকযোগে পাঠিয়েছি।" অপরদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শেফালিকা ত্রিপুরা জানান, নির্বাহী কর্মকর্তা বা অন্যান্য কর্মকর্তার ঘুষ দাবির বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে চেয়ারম্যান ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক দিতে তিনি এক লাখ টাকা নিয়েছেন। এ সময় চেয়ারম্যান বলেন, "মন্ত্রণালয় থেকে এমনি এমনি টাকা আসে না, সেখানেও টাকা দিয়ে বরাদ্দ আনতে হয়।"
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, "যেটা আপনি দেখেছেন, সেটা আমি দেখেছি" বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আশীষ চাকমা উৎকোচ নেওয়ার বিষয়ে মুঠোফোনে বক্তব্যের জন্য কল দিলে ফোন রিসিভ না করে মুঠোফোন বন্ধ করে দেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, "আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য হলে আমার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আর যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি যদি তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারেন, তাহলে ওনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার বিধান রয়েছে।" তিনি অভিযোগ মিথ্যা বলেও জানান।
নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ ঠিকাদার থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। সাধারণ জনগণও চেয়ারম্যানের অনিয়মের অভিযোগ তুলে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ করে রাজপথে নেমেছিল। এতকিছুর পরও তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সম্প্রতি চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে পরিষদের ১৪ জন সদস্যকে অবমূল্যায়ন, খারাপ আচরণ, হস্তান্তরিত বিভাগের প্রধান ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতিসহ শিক্ষক বদলি বাণিজ্য, ঠিকাদার বিলের ফাইল আটকিয়ে রেখে ঘুষ বাণিজ্য এবং চরম দুর্নীতির অভিযোগে সকল কার্যক্রম স্থগিত করে পরিপত্র জারি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তাসলীমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জিরুনা ত্রিপুরাকে চেয়ারম্যান এবং আরও ১৪ জন সদস্য নিয়ে পুনর্গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এর তিনদিন পর ১০ নভেম্বর নব নিযুক্ত সদস্যদের নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা।